সময়ের অন্তর
Amy Blankenship
তমার কামনার ব্যাপারে সতর্ক হও। ওদের সবাইকে রক্ষার উদ্দেশ্যে একটা ইচ্ছা ব্যক্ত করা হয়েছি, যদ্ধকে শেষ করার জন্য নয়, বর কিছটা বিম্বিত করার জন্য। শভ ও অশভের যদ্ধ শেষ হয়েছে... হয়েছে কি? এক কিশরী ঋত্ত্বিকাকে তার পাচ রক্ষক ভাইদের থেকে এক হাজার বছর ধরে দরে রাখা হয়েছি, যারা তাকে রক্ষার শপথ নিয়েছি। তাদের মধ্যে মাত্র এক ভাইয়েরই স্মতি অক্ষত ছি, যে সেই মহর্তের জন্য অপেক্ষা করছি যখন হায়াকহেই, অশভ সত্তার অন্তর, উদ্ভত হবে আর তাদের অস্তিত্বের ম কারণকে চরি করে নিয়ে যেতে চাইবে। ঋত্ত্বিকা হঠা করেই নিজেকে এক প্রাচীন যদ্ধভমিতে আবিষ্কার করে, যে যদ্ধ শধ শভ আর অশভের মধ্যেই ছি না... ছি ভাইদের মধ্যেও।
দ্য হার্ট অব টাইম
দ্য গার্ডিয়ান হার্ট ক্রিস্টাল সিরিজ বই ১
অ্যামি ব্ল্যাঙ্কেনশিপ
অনুবাদক: চন্দ্রিল মণ্ডল
গ্রন্থস্বত্ব © 2008 Amy Blankenship
ইংরেজি সংস্করণের প্রকাশক অ্যামি ব্ল্যাঙ্কেনশিপ
দ্বিতীয় সংস্করণের প্রকাশক TekTime
সব স্বত্ব সংরক্ষিত।
সময়ের অন্তরের কিংবদন্তি
দুনিয়া বদলে যায়... কিন্তু প্রকৃত অর্থে কিংবদন্তিরা কখনও হারিয়ে যায় না।
সময়ের একেবারে শুরু থেকেই আলো আর অন্ধকার নিরন্তর একে-অপরের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছে। এক-একটা বিশ্বের ভাঙ্গা-গড়া চলছে তাদের স্রষ্টার পদতলে, কিন্তু তা সত্ত্বেও শুভ আর অশুভর নিরন্তর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনদিন কোন প্রশ্ন হয়নি। যদিও, কোন কোন সময় এই মিশ্রণের মধ্যেই কোন নতুন জিনিস নিক্ষেপিত হয়... সেই জিনিস, যা চায় দুই পক্ষই কিন্তু পায় কোন এক পক্ষই।
চারিত্রিকভাবে বিরোধাভাসপূর্ণ এই রক্ষকের অন্তর-স্ফটিক হল সেই ধ্রুবক যা এই দুই পক্ষই বরবার অর্জনের প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। আমাদের পরিচিত বিশ্বকে সৃষ্টি ও ধ্বংস করে দেবার ক্ষমতা এই স্ফটিকাকৃতির পাথরটির রয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি আবার একই সাথে দুনিয়ার সমস্ত দুঃখ-কষ্টেরও অবসান ঘটাতে পারে। কিছু লোকের মতে এই স্ফটিকের নিজস্ব মন আছে... আবার অন্যদের মতে এই সব কিছুর পিছনে রয়েছেন ঈশ্বর।
প্রতিবার যখন স্ফটিকটি আবির্ভুত হয়েছে, এর রক্ষকেরা সর্বদা একে সেই সব লোকেদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তৈরি থেকেছেন যারা এটিকে স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করবে। এই সব রক্ষকদের পরিচয় কোনদিন বদলায়নি এবং তারা সমকালীন জগৎ বা সময় নির্বিশেষে একইরকম প্রাবল্যের সঙ্গে এটিকে ভালবেসে এসেছেন।
বহু প্রাচীন এই রক্ষকদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে, যে এদের বড়ই স্নেহের। মেয়েটির নিজের মধ্যেই এই স্ফটিকের নিজস্ব শক্তি নিহিত আছে। সেটাই স্ফটিকের ধারক ও শক্তির উৎস। এই দুইয়ের মধ্যেকার রেখাটি অনেক সময় ঝাপসা হয়ে যায়, এবং স্ফটিকটিকে রক্ষা করার কাজটি ক্রমপর্যায়ে অন্য রক্ষকদের হাত থেকে এই ঋত্বিকাকে রক্ষা করায় বদলে যায়।
এই সেই সুরা যা অন্ধকারের অন্তরের পানীয়। এটি স্ফটিকের রক্ষকদের দুর্বল করে দেবার ও আক্রমণের অবস্থায় নিয়ে আসার সুযোগ। অন্ধকার এই শক্তির কামনা করে এবং সেই সঙ্গে সেই মেয়েরও কামনা করে ঠিক যেমনভাবে কোন পুরুষ কোন নারীর করে থাকে।
এই মাত্রা ও বাস্তবতাগুলির প্রতিটির মধ্যেই তুমি একটি গোপন উদ্যানের সন্ধান পেতে পারো যা সময়ের অন্তর (Heart of Time) নামে পরিচিত। সেখানে হাঁটু মুড়ে বসা এক কমবয়সী ঋত্বিকার প্রতিমা দেখতে পাওয়া যাবে। তাকে ঘিরে রয়েছে শতাব্দী-প্রাচীন এক যাদুবিদ্যা যা তার গোপন সম্পদকে লুকিয়ে এবং অত্যন্ত যত্নে সংরক্ষিত রাখে। কুমারী প্রতিমার দুই বাহু প্রসারিত, যেন অত্যন্ত মূল্যবান কোন কিছু তার হাতে এসে ধরা দেবার অপেক্ষায় সে রয়েছে।
কিংবদন্তি আছে, সে আসলে সেই শক্তিশালী পাথরটি তার হাতে ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছে যার নাম রক্ষকের অন্তর-স্ফটিক (Guradian Heart Crystal)।
এই প্রতিমার আসল রহস্য ও কীভাবে এর সৃষ্টি হয়েছিল তা শুধু রক্ষকেরাই জানেন। পাঁচ ভাইয়ের জন্মের আগেই তাদের পূর্বপুরুষ, তাদামিচি ও তার যমজ ভাই হায়াকুহেই, এই সময়ের অন্তরকে তার অন্ধকারতম ইতিহাসকালে রক্ষার কাজ করছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই যমজ ভাই সেই বিভেদপ্রাচীরকে রক্ষা করে এসেছে যা মানবজাতিকে দৈত্যদের দুনিয়ায় পদার্পণ করা থেকে আটকায়। কাজটি ছিল খুব পবিত্র এবং মানবজাতি ও দৈত্যদেরকে একে-অপরের থেকে বাঁচিয়ে ও আড়াল করে রাখার জন্য তার দরকার ছিল।
তাদের রাজত্বকালে, অপ্রত্যাশিতভাবে, এই পবিত্র স্ফটিকের কারণে কতিপয় মানব দুর্ঘটনাবশত ওই বিভেদপ্রাচীর গলে দৈত্যদের রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হয়। কোন এক বিশৃঙ্খলার সময় এই স্ফটিকের শক্তি ওই বিভেদপ্রাচীরে চিড় ধরায় যা এই দুই জগৎকে আলাদা করে রাখত। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মানবজাতির নেতা ও তাদামিচি নিজেদের মধ্যে মৈত্রী স্থাপন করে এবং বিভেদপ্রাচীরের ওই ফাঁক বুজিয়ে দিয়ে আবার এই দুই জগৎকে একে-অপরের থেকে চিরতরে আলাদা করে রাখার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।
কিন্তু ওই সময়েই হায়াকুহেই ও তাদামিটি উভয়েই ওই মানবজাতির নেতার মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়।
হায়াকুহেইয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাদামিচি ও মেয়েটির বাবা মিলে ওই ফাটল বুজিয়ে দেয়। বিপজ্জনক ত্রিকোণ প্রেমকে চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ওই বিভেদপ্রাচীরের জোর আরও দশগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে হায়াকুহেইর হৃদয় খান-খান হয়ে যায়... তার নিজের ভাই, তাদামিচি, কিনা তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে ও তার প্রিয় ঋত্বিকাকে চিরতরে আলাদা করে রাখার বন্দোবস্ত নিশ্চিত করে দিল!
ভালবাসা শুধু ভালবাসার মানুষ তৈরি করে না, হারানো ভালবাসা ভয়ংকর অপরাধী তৈরি করতে পারে। হায়াকুহেইয়ের ভগ্ন-হৃদয় তার মধ্যে আক্রোশের আগুন জ্বালিয়ে নিল এবং হিংসায় অন্ধ হয়ে সে তার নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হল, যা তাদামিচির জীবন শেষ করে দিয়ে দুই যমজ ভাইয়ের অমর আত্মাকে আলাদা করে দিল। অমরত্বের সেই ছোট ছোট টুকরো পাঁচজন নতুন রক্ষক সৃষ্টি করল যারা ওই বিভেদপ্রাচীরের রক্ষা করবে এবং তাকে হায়াকুহেইয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখবে যে অশুভ জগতে প্রবেশ করে দৈত্যদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।
অন্ধকার জগতের আঁধারে আটক হায়াকুহেই সময়ের অন্তরকে রক্ষা করার তার সমস্ত সংকল্প বিস্মৃত হয়েছিল... উল্টে সে তার সমস্ত শক্তি ওই প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার উদ্দেশ্যে কাজে লাগিয়েছিল। তার ঘন কালো লম্বা চুল, যা হাঁটুর নিচ অবধি যায়, এবং তার চূড়ান্ত সম্মোহনকারী মুখ তার দেবদূতের মতো চেহারা-ছবির পিছনে প্রকৃত অশুভ চরিত্রকে লুকিয়ে রেখেছিল।
আলো ও অন্ধকারের শক্তির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে, কুমারী ঋত্বিকার পুনর্জন্ম লাভের ও অন্য প্রান্তে স্ফটিক ভেসে ওঠার সংকেতস্বরূপ ওই পবিত্র প্রতিমা থেকে চোখধাঁধাঁনো নীল রংয়ের আলো নির্গত হল।
রক্ষকেরা যেহেতু তার কাছাকাছি চলে আসে এবং তার রক্ষী হয়ে ওঠে, তাই শুভ ও অশুভর যুদ্ধ সত্যি-সত্যিই শুরু হয়ে যায়। তাই অন্ধকার জগতের প্রবেশপথ আলোর জগতের মধ্যেই রয়ে গেল।
তাদের বহু মহান দুঃসাহসির কাজের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম...
অধ্যায় ১ "খণ্ডবিখণ্ড স্মৃতিমালা”
"কিওকো!!!!!!"
তয়ার চিল-চিৎকার জঙ্গলের সব প্রান্ত থেকে শোনা যাচ্ছিল। সেই চিৎকারের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল এবং সব কিছু আবার নিথর, শান্ত হয়ে উঠল, আর সবাই হায়াকুহেই এরপর কী করে তা দেখার অপেক্ষায় চেয়ে রইল।
কেউ-ই এটা থামাতে পারত না। সব কিছু এত দ্রুত গতিতে ঘটে গেছিল যে কেউ কোন প্রতিক্রিয়া দেবার সময়ই পেয়ে ওঠেনি। যা ঘটেছিল তাতে ওই পাঁচ রক্ষকের সকলেই স্থবির হয়ে পড়েছিল। তারা বিশ্বাসই করতে পারেনি যে, তারা রক্ষকের অন্তর-স্ফটিককে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে হায়াকুহেইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে... আর শুধু তাকে পরাজিত করতে, একত্রিত হয়েছিল। শুধু সেই মানুষটাকেই হারাতে যাকে তারা সকলেই ভালবাসত এবং রক্ষা করত।
ওদিকে, যুদ্ধক্ষেত্রের একেবারে কেন্দ্রস্থলে যেন তাদের সবচেয়ে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
হায়াকুহেই কিওকোকে জাপটে ধরে রেখেছিল আর তার ভয়ার্ত মুখের উপর তার দৃষ্টি স্থির করে রেখেছিল। আর হায়াকুহেইয়ের পূর্বপরিকল্পনা মতোই কিওকোর শরীরের নিচের অংশ তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। হায়াকুহেই ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করতে চেষ্টা করছিল এবং রক্ষকের অন্তর-স্ফটিককে তার দেহে এবং তার শূন্যতাকে তার অন্তঃকরণে মিশিয়ে নিতে চেষ্টা করছিল। এই দৃশ্য যারা দেখছিল তারা স্ফটিকের মধ্যে বিকৃতি আসতে দেখতে পাচ্ছিল, সেই অন্ধকার তার মধ্যে দেখতে পাচ্ছিল যা শুধুমাত্র অশুভ শক্তি থেকেই আসে।
কিওকো পাগলের মতো হায়াকুহেইয়ের থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টায় তার বুকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছিল, তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সে সেই রক্ষক প্রভুর থেকে মুক্তির চেষ্টা করছিল যে সদ্য দৈত্যে পরিণত হয়েছে; আর হায়াকুহেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল।
হায়াকুহেই সেই মুহূর্তে শারীরিক শক্তির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছিল যা তার মাংসপেশি আর রক্তবাহের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল আর কিওকোর মুক্তি পাবার সেই বৃথা প্রচেষ্টা তার হাসির খোরাক জোগাচ্ছিল। তার লম্বা, ঘন, কালো চুল তাদের দু’জনকেই এমনভাবে আঁকড়ে ধরছিল যেন সেই নিজেই একটা জলজ্যান্ত প্রাণী। সেই মধ্যরাতের মতো মিশমিশে কালো চুলের প্রান্তভাগগুলো এমনভাবে কিওকোর পিছনে একে-অপরের সাথে একটা লোহার ফিতের মতো করে নিজেদের বুনে নিচ্ছিল যাতে কিওকো তার ছোট্ট শরীরটাকে হায়াকুহেইয়ের শরীরে পড়ে যাওয়া থেকে আটকাতে পারে।
কিওকো তার শরীরের সেই টানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ক্রমশ অসহায় হয়ে পড়ছিল যা তাকে হায়াকুহেইয়ের শরীরে মিশিয়ে দিচ্ছিল। কিওকো সেই অন্ধকার, শীতল শূন্যের মধ্যে পড়ে যেতে চাইছিল না যা আসলে হায়াকুহেইয়ের অন্তরাত্মা। সে সেই শূন্যের মধ্যে তার জন্য অপেক্ষারত সমস্ত দৈত্যদের উপস্থিতি অনুভব করতে পারছিল। কিওকোর শরীরের যে যে অংশ সেই শূন্যের মধ্যে প্রবেশ করছিল সেই সেই অংশ শীতল হয়ে উঠছিল। তার পা দুটো ঠাণ্ডা হয়ে বরফের মতো হয়ে গেছিল এবং তার পায়ের সমস্ত ত্বক জুড়ে কেউ যেন লক্ষ-লক্ষ পিন ফুঁটিয়ে দিচ্ছিল।
কিওকো বুঝতে পারছিল যে, সে যদি দ্রুত কিছু একটা না করতে পারে তাহলে সে তার দুটো পা-ই হারাবে। কিওকো সেই পাঁচ ভাইকে দেখতে পাচ্ছিল যারা গত কয়েক বছর ধরে তার রক্ষা করে আসছিল... তারা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিল। তারা প্রত্যেকেই তাকে বাঁচাতে চাইছিল কিন্তু যতক্ষণ অবধি তাকে একটা বর্মের মতো করে সামনের দিকে ধরে রাখা হয়েছে ততক্ষণ অবধি তারা তার কাছে যেতে ভয় পাচ্ছিল।
কিওকো রক্ষকদের বিশ্বাসঘাতকের হাতে পরাজিত হতে চাইছিল না। এ তো ওদের সকলের কাকা… সে কেন এত কাল আগে তাদের ভাইপো-ভাইঝিদের বিরুদ্ধে চলে গেছিল? কিওকোর পান্নার মতো সবুজ দু’চোখ ভয়ংকর ক্রোধ নিয়ে ঘুরে তার শত্রুর মুখে এসে স্থির হয়ে গেছিল। তার এই অবস্থা হবার কথা ছিল না... অন্তত সে যেমনটি থেকে এসেছে তাতে তো নয়ই। পুরোটাই হয়েছিল তার নিজের ভুলের জন্যই।
তার চোখের দৃষ্টি হায়াকুহেইয়ের তীক্ষ্ণ চাউনির উপর সন্নিবিষ্ট হল। কিওকোই এই স্ফটিক এই জগতে নিয়ে এসেছিল এবং এটা তাকেই এই জগত থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে যদি তাকে সেটা নিয়ে নরকেই যেতে হয়।
কুড়ি ফুটেরও কম দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা কিউ উন্মত্ত গতিতে তার ধ্বংসাত্মক তলোয়ার ‘হাকাইশা’-কে টেনে বের করে আনল। সে কিছুতেই তার কাকার... তার শত্রুর, এই ভাবনাকে মেনে নিতে পারছিল যে সেই মানব-কন্যাকে স্পর্শ করেছে যাকে কখনও পরম শ্রদ্ধা করত। ওই উন্মাদের দুই বাহু-পাশে কিওকোকে এতটাই ভঙ্গুর একটা বস্তুর মতো দেখাচ্ছিল যে, লড়াইটা এখন অশুভর বিরুদ্ধে পবিত্রর লড়াইয়ে পর্যবসিত হয়েছিল।
রক্ষকদের রাজ্যের প্রভু... কিউ, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বয়োঃজেষ্ঠ, সেই মুহূর্তে যা করতে পারত তাতে কিওকোর আঘাত লাগা ছাড়া আর কিছুই হত না। সে মনে মনে জানত যে, স্ফটিকের শক্তি তার কোন ক্ষতি করতে পারত না কারণ এই লড়াই শুরু হবার আগেই সে এমন এক জাদুমন্ত্র ব্যবহার করেছিল যা অন্য সমস্ত জাদুবিদ্যাকে আটকে দেয়। বস্তুত, সে হায়াকুহেইয়ের দ্বারা রক্ষকের অন্তর-স্ফটিক তার বিরুদ্ধে ব্যবহারে জন্য একপ্রকার তৈরিই ছিল।
কিন্তু এখন যেটা ঘটছে... সে কখনও তার কল্পনাই করেনি। সে কোনভাবেই কিওকোকে আহত করতে চায়নি... কখনোই না, অন্তত ততক্ষণ অবধি তো নয়ই যতক্ষণ তার হাতে তাকে আটকাবার ক্ষমতা আছে।
কোন অত্যন্ত অন্ধকারময় দুঃস্বপ্ন থেকে উঠে আসা হায়াকুহেইয়ের ছেড়ে দেওয়া সেই দৈত্য-পিশাচেরা যখন মাটি থেকে ঘষটে-ঘষটে উঠে তার শরীরকে আঁকড়ে ধরে তাকে স্থবির করার চেষ্টা করছিল তখন সে এতটুকুও অসুবিধায় পড়েনি। কিউ তার ছোট ভাই তয়ার চোখে ভয়ংকর আগুন দেখতে পেল।
হায়াকুহেইয়ের তার কিছু দৈত্য-পিশাচ দিয়ে তয়াকে আক্রমণ করেছিল, তাকে স্থবির করে দেবার চেষ্টায়, কিন্তু তয়া তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধের চেষ্টা তখনও ছটফট করছিল। ভিতরে-ভিতরে, কিউ তার ভাইয়ের উপর থাকা এই প্রতিরোধী শক্তিকে ধন্যবাদ দিচ্ছিল... কারণ যদি তা না থাকত, তাহলে তয়া ভবিষ্যৎ পরিণামের কথা না ভেবেই আক্রমণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিওকোকে এইরকম এক বিপদে পড়তে দেখে তয়া দিক-বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছিল।
কিউ তয়ার প্রতিটা হৃদস্পন্দের সাথে সাথে তার রক্ষকের শক্তির তীব্রতার বৃদ্ধি অনুভব করতে পারছিল, যার মধ্যে তার নিজের ও তার ভাইয়েদের শক্তিও মিশে ছিল।
দশ ফুটেরও কম দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা কোতারোর বরফের মতো নীল চোখ অবিশ্বাসের বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠেছিল। সে কোনভাবেই কিওকোকে আহাত হতে দেখতে চাইছিল না, কিন্তু তা যাতে না হয় তার জন্য তার কিছু করারও ছিল না। তার দুই বাহুই যুদ্ধের রক্তে সিক্ত ছিল এবং তার পা দুটোও খুব একটা ভাল অবস্থায় ছিল না। তার নিজের ব্যথায় এই মুহূর্তে সে এতটাই কাতর ছিল যে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও তার কষ্ট হচ্ছিল, আক্রমণ করার মত শক্তি তো তার ছিল না। সে সবচেয়ে বেশি যে মেয়েটিকে ভালবাসত তার জন্য তার মন ভয়ে পাথর হয়ে গেছিল।
"ওর যেন এতটুকু আঘাত না লাগে, হায়াকুহেই, তাহলে আমি তোকে নরক থেকে টেনে বের করে আনব," কোতারে তার ধরা গলায়, তার বিষদাঁত বের করে, তার বরফের মতো নীল চোখে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে নিয়ে কথাগুলো বলেছিল। তার চারপাশের বায়ুও যেন প্রতিশোধের আগুনের উষ্ণতা পেয়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল, তার শক্তি-প্রবাহের ফলে তার চারিপাশের ধ্বংসাবশেষ একটা বৃত্ত তৈরি করে উড়ছিল।
কামুই ভয় পেয়ে গেছিল এবং কিওকোকে হায়াকুহেইয়ের বাহু-পাশে ছটফট করতে দেখে তার মস্তিস্কে তালা গেলে গেছিল। তার চোখে বহুবর্ণের ধূলিকণা ক্রোধের আগুনে চিকচিক করছিল। কোন পরিণামের কথা না ভেবেই, কামুই তার দুই পাঞ্জা প্রসারিত করে হায়াকুহেইয়ের দিকে ছুটে গেছিল, ঋত্বিকার জন্য তার ভালবাসা থেকে উদ্ভুত সেই অকল্পনীয় শক্তিকে সবাই প্রত্যক্ষ করেছিল।
হায়াকুহেইয়ের ছায়া দৈত্যেরা, তার শরীরকে নিরেট ধ্বংসাবশেষের মধ্যে আছড়ে, নোংরা উড়িয়ে, তাকে পিছু হঠতে বাধ্য করেছিল।
কেয়েন, যে লড়াই চলাকালীন পুরো সময় ধরে সর্বকনিষ্ঠ রক্ষককে চোখে-চোখে রাখছিল, শক্ত হাতে কামুইকে তাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল এবং তার দু’পায়ের চলনে আগুন উড়ছিল। নিস্তেজ কামুইকে বাঁচিয়ে নিয়ে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে কেয়েন আগুন-ঝড়ানো চোখে হায়াকুহেইয়ের দিকে তাকাল এবং সর্বকনিষ্ঠ রক্ষক ও তার বিপদের মাঝখানে এসে দাঁড়াল।
সুকি তখনও তার বাবাকে দু’হাতে ধরে হাঁটুগেড়ে মাটিতে বসে ছিল। তার শরীর এখন নিথর এবং সেনিমকে হত্যার জন্য হায়াকুহেইয়ের প্রতি তার ঘৃণা সুকির অন্তঃকরণে টগবগ করে ফুটছিল। সুকির চোখ এইবার কিওকোর উপর এসে স্থির হয়ে গেছিল। সে তার সবচেয়ে ভাল বান্ধবীকে সেই নিয়তির হাত থেকে রক্ষা করতে চাইছিল যা তার বাবার মতো বুদ্ধমান বৃদ্ধকে শেষ করে দিয়েছিল।
শিনবে সুকির ঠিক সামনেই তার রক্ষাকবচের মতো দাঁড়িয়েছিল, হায়াকুহেইয়ের দৃষ্টি থেকে তাকে আড়াল করে। কোতারোর রোষানল থেকে উদ্ভুত বায়ু শিনবের মুখের উপর এসে পড়া তার মিশমিশে কালো চুল হাওয়া উড়াচ্ছিল... যা তার নীলকান্ত মণির মতো চোখে ভয়ার্ত এক অভিব্যক্তি তৈরি করেছিল। স্ফটিক ভবনের শক্তির অনুভূতি হওয়ামাত্র কিওকোর জন্য তার চিন্তা আরও তীব্র হয়ে উঠল।
সহসা তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে যাওয়া কোন বায়ু যেন তার মুখ থেকে “না….” শব্দ বের করে এনেছিল। শিনবে এ কথা জানত যে, হায়াকুহেই যদি রক্ষকের অন্তর-স্ফটিকের সমস্ত শক্তি হস্তগত করে ফেলে, তাহলে দুই জগতের সামনেই সমূহ বিপদ উপস্থিত হয়ে পড়বে। আর এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সে কিছুই করতে পারছিল না এই কথা ভেবে তার দু’চোখ বেয়ে অগ্নিরূপ অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকল। “…কিওকো।”
হায়াকুহেই তার চারিপাশে এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা তার শত্রুদের দিকে তাকাল... তার নিজের ভাইয়ের পুত্রের দিকে তাকাল। ও জানত এরা সবাই ওকে আক্রমণ করতে ভয় পাচ্ছে কারণ এই মুহূর্তে কিওকো তার কজ্জায় রয়েছে তার ঢাল হিসেবে এবং সে তার চারিপাশে ক্ষোভের আগুনের লেলিহান শিখা অনুভব করতে পারছিল।
তার মিশকালো দুই পাখা প্রসারিত হল, যা তার পিছনে একটা অন্ধকার পটভূমি রচনা করল, আর সেই সঙ্গে তার ততধিক কালো দুই চোখ তার হাতে থাকা মেয়েটির উপর স্থির হয়ে রইল। "ওরা তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।" সে খুব শান্ত স্নিগ্ধ গলায় বলল। তার কথা এমন ছিল যেন তারা কেউ-ই এই যুদ্ধভূমিতে নেই, বরং তারা বাইরে থেকে তা দেখছে।
সে সেই পবিত্র রক্ষকের অন্তর-স্ফটিকের স্পর্শ অনুভব করতে পারছিল যেটা তখনও তার উন্মুক্ত ছাতির ঠিক মাঝখানে জ্বলজ্বল করছিল। কিওকোকে রক্ষার জন্য লড়াই করা রক্ষকদের প্রতি কিওকোর ভালবাসাই সেই একমাত্র জিনিস ছিল যা ওই স্ফটিকের অবশিষ্ট অংশটা হায়াকুহেইয়ের শরীরে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাচ্ছিল না, তাকে সেই শক্তির সুখ দিয়ে যা তার চির-আকাঙ্খার বিষয়।
কিওকোর সেই বিশুদ্ধ ভালবাসাই তার শক্তি, আর তাই দিয়েই সে হায়াকুহেইয়ের শরীর থেকে পবিত্র স্ফটিকটিকে টেনে বের করে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছিল... হায়াকুহেই তা বেশ অনুভব করতে পারছিল। কিন্তু তার সাথে সাথে সে সেই শক্তিকেও অনুভব করছিল যা সেই মুহূর্তে তারা শিরা-ধমনীর মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল, এবং যা তাকে আরও আরও পেতে প্ররোচিত করছিল।
হায়াকুহেইয়ের চোখ দুটো কয়েক মুহূর্তের জন্য নরম হয়ে গেল যখন কিওকোর সাথে ফিসফিস করে কথা বলছিল যেমন করে কোন প্রেমিক তার প্রেমিকার সঙ্গে বলে। “এটা যথেষ্ট নয়।”
হায়াকুকেই ঠিক করল যে সে এখনও অবধি ওই পবিত্র স্ফটিক থেকে যতটুকু শক্তি অর্জন করতে পেরেছে তাকেই কিওকোর বিরুদ্ধে কাজে লাগাবে এবং তার এই ভালবাসর বন্ধনকে ভেঙ্গে ফেলতে চেষ্টা করবে যা তার শরীরের চারিপাশ বেষ্টন করে রয়েছে। সে বুঝতে পেরেছিল যে, তাকে যে কোনভাবে হোক কিওকোকে নিরস্ত করতেই হবে... কারণ কিওকোর ভালবাসার শক্তি নিজের মধ্যেই সেই পবিত্র স্ফটিকের শক্তির সমকক্ষ যা এক সময় তার হাতেই ছিল। এ সেই স্ফটিক যাকে এক সময় ভালবাসার অধিকার তার ছিল... যতক্ষণ অবধি না সেই অধিকার নিষ্ঠুরভাবে তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
সে এক ঝটকায় কিওকোর মুখটা নিজের মুখের কাছে টেনে নিল এবং আলতো করে তার নিষ্পাপ ঠোঁটের উপর একটা চুম্বন করল। তার চঞ্চল সুবজ চোখে তাকিয়ে হায়াকুহেই রক্ষকের অন্তর-স্ফটিকের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তার অন্তঃকরণে প্রবেশ করল।
হায়াকুহেই রক্ষকদের প্রতি তার স্নেহস্মৃতির খোঁজ করল যাদের কিওকো অত্যন্ত ভালবাসত... হায়াকুহেই ওর থেকে তা নিয়ে নেবে। সে যাদের জন্য লড়াই করত সেই সব মানুষগুলোর স্মৃতি কিওকোর থেকে চুরি করে নিলে কিওকোর শক্তি কমবে এবং সেই শক্তি হায়াকুহেইকে আরও শক্তি জোগাবে।
কিওকো তার চোখের পাতা ফেলতে পারছিল না। কিওকো তার মনের মধ্যে হায়াকুহেইয়ের অশুভ পাঞ্জার চলাফেলা অনুভব করতে পারছিল যা তার স্মৃতিকে নষ্ট করে দিতে চাইছিল এবং এই লড়াইয়ে তার সংকল্পকে খানখান করে দিতে চাইছিল... তার ভালবাসাকে তার থেকে আলাদা করে দিতে চাইছিল। তার বন্ধুরা, তাদের সকলেই, সে নিজেও এটা হতে দিতে পারে না।
কিওকো বুঝতে পারছিল সে তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, তার কাছে শুধুমাত্র একটাই জিনিস থেকে যাচ্ছে হায়াকুহেইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য, আর সেটা হল সেই জিনিস যা হায়াকুহেই তার থেকে ছিনিয়ে নিতে এবং তাকে ধ্বংস করে দিতে চাইছিল। তার চোখে ক্রোধের আগুন আর চাপা দেওয়া যাচ্ছিল না। কিওকো হায়াকুহেইয়ের রেশমি, মিশকালো চুলের মধ্যে তার হাতি চালিয়ে দিয়ে তাকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরল এবং তার কপালে নিজের কপাল সজোরে আঘাত করল, যা শক্তি এক তরঙ্গ তৈরি করল।
কিওকোর প্রবল চিৎকারে গোটা যুদ্ধক্ষেত্র ফেটে পড়ল। "এতটাই খারাপ হোক চেয়েছিলে তো? নাও তবে!! এই নাও!!!!"
কিওকোর সোনালি চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল যা থেকে যেন একটা উত্তপ্ত ছুরির মতো ত্রাস ছিটকে বেরিয়ে হায়াকুহেইকে বিদ্ধ করছিল। ঋত্বিকা কী করছিলেন? হায়াকুহেই জানত কিছু একটা মারাত্মক ভুল হয়ে যাচ্ছে এবং তার ভিতর থেকে তার মানসিক শক্তি তাকে ডাকছিল... যেন তাকে শোনার জন্য এবং অনেক দেরি হয়ে যাবার আগে একবার দেকে নিতে আকুতি জানাচ্ছিল। সে সেই শক্তিকে গুটিয়ে এনে কিওকোর মনের ভিতরে প্রবেশ করেছিল, কী ঘটছে তা দেখার জন্য। তার ছায়া দৈত্যরা তাকে চারপাশ থেকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে না থাকলে... একেবারে স্থিরভাবে, সে যা দেখতে পেয়েছিল তাতে হায়াকুহেই নিজের হাঁটুতে ভর দিয়ে মাটিতে পড়ে যেত।
সেই ছবি ও আওয়াজগুলি চিরতরে তার মনের চোখে বসে যাবে এবং কিওকো কোনভাবে জানত যে, হায়াকুহেই সেই অনুভূতিগুলিকে নাড়াতে পারবেই না যেগুলি তার উপর দিয়ে বয়ে গেছিল। কারণ তার অন্তঃকরণের চোখে চোখ রেখে হায়াকুহেই বুঝতে পেরেছিল যে, কিওকোর অন্তরে তার জন্য ও তার ভাইদের জন্যও ভালবাসা রয়েছে। সেই প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি আবেগঘন আদর দেখতে পাচ্ছিল এবং সেই প্রতিটি লুকানো ভালবাসার অশ্রু দেখতে পাচ্ছিল যা অবশ্যই কিওকোর মধ্যে তার জন্যই ছিল।
কিউ একেবারে ভিতর থেকে নড়ে উঠেছিল এই সময় কারণ সে জানতে কিওকোর মধ্যে যে কোন কারো থেকেই অনেক বেশি শক্তি রয়েছে... এমনকি তার মধ্যে এমনও শক্তি আছে যা কিওকোর নিজেরই অজানা। কিউ সেই প্রতিটি স্মৃতিকে দেখতে ও অনুভব করতে পারছিল যেগুলো কিওকোর মন থেকে বেরিয়ে হায়াকুহেইয়ের মনে প্রবেশ করছিল, যেন কোন তীর তার মনের মধ্যে ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ছিল যেখান থেকে সে আর সেগুলোকে কখনই বের করবে না।
বহু বছরের ভালবাসা, মর্মপীড়া এবং ত্যাগ... এক মুহূর্তেই সব চলে যাচ্ছে।
ক্রোধের আগুনে গলে যাওয়া অশ্রু কিওকোর গাল বেয়ে নামছিল আর সে প্রত্যেকের জন্য তার ভালবাস ও বন্ধুত্বের, যন্ত্রণার ও রহস্যের অনুভূতির স্মৃতিগুলোকে হায়াকুহেইয়ের মনের মধ্যে থেকে টেনে বের করে নিজের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। তার হাতে এই শেষ অস্ত্র ছিল।
একেবারে সাথে সাথেই হায়াকুহেইয়ের অশুভ শক্তি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ল। স্ফটিকটি অন্ধ আলো থেকে উজ্জ্বল সাদা আলোয় দপদপ করতে দেখে সকলেই শক্তির হাতবদল বুঝতে পারছিল, আর তখনই তয়া ও কিউকে আঁকড়ে ধরে থাকা অপচ্ছায়াগুলির মুষ্টি শিথিল হয়ে বায়ুর সঙ্গে মিলিয়ে যেতে থাকল।
কিওকো এখন অন্ধকারের দেবদূতকে বিভ্রান্ত অবস্থায় দেখতে পেল, তার ফ্যাকাসে মুখটা যন্ত্রণায় দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিল।
ঠিক যে মুহূর্তে কিওকো বুঝতে পারল যে সে পিছলে বেরিয়ে আসছে তখনই সে ছোট-ছোট দুই বাহু প্রসারিত করল এবং স্ফটিকটিকে শক্ত করে ধরল এবং হায়াকুহেইয়ের মাংসপিণ্ডের মধ্যে থেকে টেনে বের করে নিল। কিওকো জানত কী করা উচিত, কারণ সে বেশ অনুভব করতে পারছিল যে সে তার মনে সেইসব স্মৃতিগুলোকে দ্রুত হারাচ্ছে যেগুলোকে সে হারাতে চাইত না। ইতিমধ্যে অশ্রুধারা বয়ে যাওয়ার চিহ্ন থাকা তার গাল বেয়ে স্ফটিকাকৃতির চোখের জল নামছিল।
সে তার সমস্ত স্মৃতিগুলোকে হারিয়েছিল তাদের সকলে বাঁচাতে। দ্রুতগতিতে, তার চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলার আগেই, সে রক্ষকের অন্তর-স্ফটিককে তার বুকের সঙ্গে চেপে ধরেছিল... তার হৃদয়ের মুখোমুখি।
তারপর মুখ ফিরিয়ে তয়া আর কিউয়ের দিকে তাকিয়ে, যারা তার দিকেই এগিয়ে আসছিল, সে ফিসফিস করে বলল, “আমাকে মনে রেখো... আমার খোঁজ কোর।”
তার দৃষ্টি এক কালো অন্ধকার সুড়ঙ্গে প্রবেশ করার আগে শেষ যে দৃশ্য কিওকো দেখতে পেয়েছিল তা হল তয়া ও কিউ চিৎকার করে তার নাম ডাকছিল এবং তার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল। ওদের দু’জনের একজনের চোখ ছিল সোনালি আর অপরজনের চোখ ছিল গলিত রূপার রংয়ের... আর তারপরও কিওকোর জগৎ অন্ধকারে ডুবে গেল।
কিওকোর মিলিয়ে যাওয়া এবং সে যে মারা যেতে চলছে সেই ভাবনা কিউ অনুভব করতে পারছিল। সে তয়ার সঙ্গে সমলয়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিওকোর কাছে পৌঁছানোর মরিয়ে চেষ্টা করছিল, আর ঠিক তখনও সব বদলে গেল, যেন এক বিন্দু জল তার চোখের মণিতে এসে আছড় পড়ল। কিওকোর দিক থেকে তরঙ্গ তৈরি হল, আর সে মধ্যগগনে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর তারই সঙ্গে মিলিয়ে যেতে যেতে ক্রোধে উম্মত্ত হায়াকুহেইয়ের চিৎকারও শোনা গেল।
কিউয়ের মনটা ছাৎ করে উঠল যখন তার সঙ্গে একই স্বরে চিৎকার করতে থাকা তার ভাইয়ের কণ্ঠস্বর হঠাৎ করে থেমে গেল, কেউ যেন এক নিমেষে কণ্ঠের তার ছিন্ন করে দিয়েছিল, এবং সে বুঝতে পারল তয়াও তাদের সাথেই মিলিয়ে গেল। কিউ ঝপ করে সেই খালি বদ্ধভূমিতে এসে পড়ল যেখানে মাত্র এক মুহূর্তে আগেই তার অভীষ্ট লক্ষ্য অবস্থান করছিল। তার ক্রুদ্ধ চোখের দৃষ্টি চারিদিকে তাকে খুঁজল কিন্তু কাউকেই আর দেখতে পেল না। সকলেই অদৃশ্য হয়ে গেছিল।
কিউ তার অ্যাড্রিনালিক গ্রন্থিতে প্রচন্ত আলোড়ন অনুভব করতে পারছিল এবং বুঝতে পারছিল তা থেকে ক্ষরিত রস তার রক্ষক রক্তে গিয়ে মিশছে। কোন কিছুই তার দৃষ্টি আর অনুভূতির বাইরে ছিল না। সে এখন কিওকোর সবটুকু স্মৃতির মালিক হয়ে রইল। কিওকো তাদেরকে বাঁচাতেই তার জীবনের সবটা দিয়ে গেছিল, আর তার চলে যাবার আকের মুহূর্ত অবধি কিউ তার সেই অঙ্গীকার শুনতে পেয়েছিল। কিওকো হয়ত জানতেই পারেনি সে কী করে গেছিল... কিন্তু সে তার সবকিছু তার সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেছিল, শুধু কিউকে পিছনে ফেলে রেখে।
কিউ তার চারিদিকে যে সম্মোহন বিছিয়ে রেখেছিল যাতে ওই পবিত্র স্ফটিককে তার বিরুদ্ধেই কাজে লাগানো না যেতে পারে, সেই সম্মোহনী শক্তিই তাকে অন্যদের গন্তব্য অনুসরণে অক্ষম করে তুলেছিল। মাত্র কয়েকটা ফিসফিস শব্দেই কিওকো তার থেকে তার সব কিছু ছিনিয়ে নিয়েছিল।
তার শরীর ঋজু ও উদ্ধত অবস্থায় ছিল। তার হাঁটু অবধি বিস্তৃত রূপালী রংয়ের চুল তার দেহের চারিদিকে ঝুলছিল এবং তার সাদা রংয়ের রেশমের জামার হাতা হাওয়ায় পৎপৎ করে উড়ছিল যেন সে কোন অদৃশ্য ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল যে ঝড়ের সঙ্গে তার ক্রোধে অন্ধ হয়ে যাওয়া তার অন্তরের মধ্যে চলা ঝড়ের মিল ছিল।
তার দৃশ্যপট থেকে মিলিয়ে যাওয়া মল্লভূমির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা তার চেহারা-ছবি অনেকটা কোন দেবদূতের মতো লাগছিল... রাজকীয়, পরাক্রমী এবং নিষ্কলঙ্ক। সহসা সে তার হাত তার গালে নিয়ে এল যেখানে একাকী এক অগ্নিবর্ণ অশ্রু ধীরে ধীরে নেমে আসছিল যাকে আটকানোর মত ক্ষমতা তার সেই সময় ছিল না।
কিউয়ের দৃষ্টি পাখির গা থেকে খসে পড়া পালক যেভাবে ভেসে বেড়ায় সেইভাবেই ভেসে বেড়াচ্ছিল, তাকে এক বিশালাকার সোনালি দমকে মুড়ে দিয়ে, তার বয়স-বিহীন জীবনকে প্রথমবারের জন্য উদ্ঘাটিত করে।
এই মল্লভূমি থেকে যে একমাত্র আঘাত সে পেয়েছিল তা তার হৃদয়ে আড়াআড়িভাবে প্রতীত হচ্ছিল... সেই হৃদয় যা আদৌ আছে বলে কেউ কোনদিন ভাবেনি। তার দৃষ্টি আন্দোলিত হচ্ছিল সেই কুমারী প্রতিমার উপর যা মাত্র কয়েক ফুট দূরত্বেই দাঁড়িয়েছিল এবং সে ফিসফিস করে বলে উঠল, “কিওকো, আমি তোমাকে ত্যাগ করিনি। তোমাকে আবার খুঁজে পেতে এক হাজার বছরের দূরত্বও আমার কাছে কিছুই নয়….”
অধ্যায় ২ "অপর দিক"
সময়ের অন্তরের অপর দিকে, দু’বছর পরে... এবং ভবিষ্যতে এক হাজারেরও বেশি বছর পরে।
চিঠিটা হোগো মঠের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছিল। কিছু আগেই পত্রবাহেকর দেওয়া অতি সুন্দর দেখতে ওই খামটাকে হোগোদাদু তার সঙ্গে করে নিয়ে তার সেই টেবিলের দিকে ফিরে যেতে যেতে সেটাকে দেখলেন, যেখানে বসে তিনি চা পান করছিলেন। দরজায় কড়া নাড়া শোনার আগে অবধি তিনি তার বেশিরভাগ সময়ে অতি সক্রিয় থাকা বাড়ির শান্তি ও নীরবতা উপভোগ করছিলেন।
বাকি সকলেই সেই সন্ধ্যের জন্য বাইরে বেরিয়েছিল। তামা তার বন্ধুদের সঙ্গে শহরের গেম ক্লাবে, আর কিওকো লাইব্রেরিতে পড়তে গেছিল, অন্যদিকে, মিসেস হোগো কিছু মুদিখানা সামগ্রী কেনাকাটার জন্য বেরিয়েছিলেন।
টেবিল থেকে একটা ছুরি তুলে নিয়ে দাদু সোনালি তারের প্রান্তের খামটির একপ্রান্তে চালিয়ে দিলেন। তারপর ভিতরে হাত চালিয়ে সোনালি তারের পান্তযুক্ত উচ্চমূল্য প্রদত্ত চিঠিটা বের করে আনলেন এবং পড়তে শুরু করে দিলেন। তিনি যত পড়ছিলেন তার চোখ ততই বিস্ফারিত হচ্ছিল। বিষয়টা ছিল একটা স্কলারশিপ প্রসঙ্গে, শহরের অপর প্রান্তের শহরতলির কোন এক অতি ব্যয়বহুল স্কুলের সম্পূর্ণ পঠন-পাঠনের স্কলারশিপ।
"কে.এল. বিশ্ববিদ্যালয়।" বহু বছর পর প্রথমবার তার বৃদ্ধ কণ্ঠে বিস্ময়ের শ্বাসাঘাত দেখা গেল। তাতে লেখা ছিল, সমস্ত খরচ মিটিয়ে দেওয়া হবে, এমনকি সে যে ছাত্রাবাসে থাকবে তার ভাড়াও, এবং তাতে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতার স্বাক্ষর ও তার নামের অদ্যাক্ষর কে.এল. লেখা ছিল।
দাদুর বৃদ্ধ মুখটাতে বহু বছর পর চওড়া হাসির রেখা দেখা গেল। কিওকো আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়তে চলেছে। তিনি জানতেন ও এ ব্যাপারে খুবই চিন্তিত ছিল যে, স্কুলে এতদিন ধরে না যেতে পারার কারণ হয়ত ওকে আর কোন স্কুলেই নেওয়া হবে না এবং ওর পড়াশোনা হয়ত শেষই হয়ে যাবে, কিন্তু এখন ও সব্বাইকে টপকে সেই স্কুলে যেতে চলেছে যেটা এই অঞ্চলের অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের থেকে ভাল।
কিছু একটা চিন্তায় তার কপালে ভাঁজ পড়ল... এটা এমন একটা স্কুলে যেটাতে ভর্তি হতে পারাটা সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার, কারণ তার চেনা কাউকেই তিনি আজ অবধি এই স্কুলে ভর্তির জন্য আবেদন করে সফল হতে দেখেননি। আবার এই রটনাও আছে যে, এই স্কুলে নাকি শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম যেহেতু এখানে ভর্তি হতে গেলে অত্যন্ত উচ্চমানের আবশ্যকতা পূরণ করতে হয়। ও কীভাবে এমন একটা স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেল যার জন্য ও আবেদন পর্যন্ত করেনি?
তার মাথায় গত দু’বছরের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা ঘোরাফেরা করতে লাগল। মঠ থেকে সব কিছু ভুলে গিয়ে কিওকো যখন ফিরে এসেছিল তখন তার স্বাভাবিক হতে বেশি কিছুটা সময় লেগে গেছিল। সে হঠাৎ করে কবে ফিরে এসেছিল সে ব্যাপারে এরা সকলেই বেশ বিভ্রান্ত ছিল, কারণ ও চলে যাবার পর থেকে ওর আর বিশেষ কিছু মনে ছিল না।
হোগো পরিবার জানত সে কোথায় গেছিল কারণ ও বহুবার পা ফসকে সময়ের তোরণে এপাশ-ওপাশ করেছিল... কিওকোই একমাত্র মেয়ে যে হঠাৎ করেই সব কিছু ভুলে বসেছিল।
তার এমনকি তয়ার কথাও মনে ছিল না। কিন্তু দাদুর কাছে সে সব ঠিকই ছিল, কারণ সময়-অতিক্রমী রক্ষকের ব্যাপারে ও যদি ভুলে যায় তাহলে তার থেকে ভাল আর কিছু হয় না। অন্য ওই দিকের ব্যাপারে এবং যে বিপদ তার সাথে এসেছিল সে সব কিছু যে ও ভুলে গেছে সেটা ভালই হয়েছে।
কিছুক্ষণের জন্য তার চোখে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছিল। হ্যা, যা ঘটেছিল পরিবারের সকলেই তার প্রায় সবটাই জানে, কারণ কিওকো দুই বিশ্বের মধ্যে যাতায়াত করত এবং যখন সে তাদের দিকে থাকত, তখন সে তাদের সবাইকে সবচেয়ে বেশি আনন্দে রাখত। বৃদ্ধ এ-ও জানতেন যে, কিওকো এমন অনেক কিছুই তাদের থেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল যা ও চাইত না সকলে জানুক। সেই জিনিসগুলো এরা আর কোনদিনই জানতে পারবে না কারণ এখন ও সেই সব গোপন রহস্যই ভুলে গেছে।
এমনকি তার ছোট ভাই তামা তাকে অনেক কিছুই বলেছিল যা সে জানত; কিন্তু সে সব শুনে ও শুধু মাথা নেড়েছিল এবং চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। ওর শুধু মনে ছিল যে, ও সেই অন্য জগতে একেবারে একা ছিল। দৈত্য পরিপূর্ণ একটা জগতে।
আনন্দের টানে দাদুর ঠোঁট দুটো পাতলা হয়ে এসেছিল। তিনি জানতেন সব আবার ঠিকঠাক হয়ে গেছিল কারণ কিওকো তাকে বলেছিল সে তার অন্তরের মধ্যে অনুভব করতে পারে যে, রক্ষকের অন্তর-স্ফটিক আবার তার কাছে ফিরে আসছে, আর সেটা হয়ে এসেও গেছে। কয়েক সপ্তাহ পরে, সে তার স্কুলের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় এবং খুব ভাল ফল করতে শুরু করে। দাদু সদর দরজা খোলার শব্দ পেলেন এবং তার মুচকি হাসি প্রসারিত হল।
তিনি চিঠিটাকে একটা সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে চুমু খেতে খেতে তার নাতনীকে রান্নাঘরে প্রবেশ করতে দেখছিলেন... কিওকোর খুব ভাল লাগবে।
*****
তিন সপ্তাহ পরে...
অতীতের কোল থেকে বেরিয়ে আসা মেয়েটা যখন স্কুলের দিকে যেত তখন স্বর্ণাভ আলোয় ভরা চোখ তাকে দেখত। সে ওকে খুঁজে পেয়েছিল এবং কোনভাবে সে আবার সবকিছু ঠিক করে দেবে। সে তারা মানবদেহ কিছুক্ষণের জন্য খসে গেছে বলে অনুভব করেছিল এবং তার চোখে সোনা-ঝড়া স্মৃতিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছিল সেই দৃশ্যের কথা ভেবে যা সেই মারাত্মক যুদ্ধভূমিতে ঘটে গেছিল।
জানালার ও প্রান্ত থেকে ঘরে প্রবেশ করা সকালের সূর্যালোক ঘরের দেওয়ালে তার পিছনে যে ছায়া তৈরি করেছিল তাতে একটা অদ্ভুত অবয়ব ধরা পড়েছিল যার পিছনে পাখা ছিল। সে তার পাঞ্জা সমেত বাহু উপরে তুলল এবং তার চোখের দৃষ্টি সংকুচিত করল, আর তার পাঞ্জা দুটোকে ধীরে ধীরে মানব পরিধানের মধ্যে মিলিয়ে যেতে দেখল।
তার সেই রহস্যাবৃত চোখে সে ঋত্বিকার দিকে ফিরে তাকাল, তার অন্তরের শক্তিকে সে শান্ত করল। সময় ও কিওকোর পবিত্রতা দুইয়ে মিলে তাকে তার চারিপাশে অশুভের উপস্থিতির অনুভূতি দিচ্ছিল। অসমাপ্ত সেই যুদ্ধ শীঘ্রই শুরু হবে। আর এবার... সে আর আগের মত ভুল করবে না।
কিওকো বিশাল ভবনটার দিকে মাথা তুলে তাকাল। তার কাছে এটা তার অজানা অতীতের কোন মহান প্রাসাদের মত লাগছিল। সে নিজের মধ্যেই মুচকি হাসল। না হেসে সে পারল না। স্কলারশিপের কথাটা জানতে পেরে এবং এটা জানতে পেরে যে, সে এখন সত্যি-সত্যিই এখানে থাকতে চলেছে, সে অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছিল।
সে তামার দিকে ফিরে তাকাল। তার ব্যাগ ও জিনিসপত্র গুছিয়ে দিতে তামা তাকে প্রচুর সাহায্য করেছিল। কিওকো তার মা এবং দাদুকে সে যে এখানে থাকতে যাচ্ছে তা বলতে পেরে এবং তাদের বিদায় জানিয়ে বেশ আনন্দ পেয়েছিল। এখন এই বিপুল স্বাধীনতার হাতছানি তার মনকে অনেকটা ঝরঝরে করে তুলেছিল। সে একটা দীর্ঘস্বাশ ফেলেল এবং তার আস্বাদ গ্রহণ করল।
“কি রে কিওকো, তুই কি সারা দিন ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি ভিতরে গিয়ে নিজের ছাত্রাবাসের ঘরটা খুঁজে নেবে?” তামা ধমকে উঠে বলল, যদিও গোটা দৃশ্যটা তাকেও বেশ মুগ্ধ করেছিল। তামা বিস্ময় দৃষ্টিতে মূল ফটকের দিকে যাবার মহীরূহ খিলানটাকে মাথা তুলে দেখছিল।
কিওকোর হাতে একটা মানচিত্র ধরা ছিল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঠিক দিকটাকে যুক্তকারী ওই বিশালাকার ভবনের উপর তার তর্জনী রেখেছিল। "ওটাই সেই ভবনটা হওয়া উচিত।" কিওকো পিছন ফিরে তাকাল এবং তামার উদ্দেশ্যে চোখ টিপল। "সকাল থেকে আমাকে এত সাহায্য করার জন্য তোকে ধন্যবাদ।"
তামা মুচকি হাসল, কিছুটা যেন বিব্রত বোধ করল। "কেন নয়, কিওকো, এইভাবেই আমি অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও তোর থেকে কিছুটা মুক্তি তো পাব, আর সেটাই অনেক।" সে কিওকোকে একেবারে বোল্ড-আউট করে দিয়েছিল মনে হল, কথাটা শেষ করে সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
কিওকো ওকে তাড়া করল আর তামা ছুটতে শুরু করল, কিন্তু কিওকো কিন্তু হঠাৎই থেমে গেল, কিওকোর মনে হল দুটো চোখ যেন ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
ঝটকা হওয়ায় কিওকোর চুল উড়ে-উড়ে আলোয় মাখা ওর সোনালি গালের উপর পড়ছিল যখন ও মাথা তুলে উপরে ভবনটার দিকে তাকাল সেই চোখ দুটোর খোঁজে যা তাকে দেখছিল বলে তার মনে হচ্ছিল, কিন্তু সে কারো দেখা পেল না। গত কয়েক বছরে সে অদ্ভুত কোন কিছুর অনুভূতি পাবার ক্ষমতা লাভ করেছিল, এবং সে বুঝতে পারছিল নিশ্চিত কেউ আছে... তাকে দেখছে। সে তার স্পর্শ অবধি পাচ্ছিল।
কিওকোর মনে হয়েছিল উপরের দিকে একটা জানালায় সে একটা গতিবিধি দেখেছিল, কিন্তু খেয়াল করে তাকানোর পর ও দেখল ওটা খালি, ওখানে কেউ-ই নেই। কিওকো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল এই ভেবে যে দুশ্চিন্তার কারণ বোধ হয় আর নেই। ও আলতো করে ওর নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে হতাশাটা কাটিয়ে ওঠার অপেক্ষা করল। এইবার সে তামাকে ধরে ফেলল কারণ ততক্ষণে সে দরজার মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করেছিল। দু’জনেই স্থির হয়ে চারিদিকটা একবার দেখল।
"এটা দারুণ জায়গা,” তামা উপরের দিকে তাকিয়ে তারপর একটু ঝুঁকে ভারি গলায় ফিসফিস করে বলল। “তোর হয়ত একটা মানচিত্রের দরকার হবে... তোকে যতটুকু চিনি, না হলে তুই এখানে পথ হারিয়ে ফেলবি।”
কিওকো সম্ভবত ওর এই সব কথা শুনলই না, কারণ ওর চোখ দুটো তখন হলের ভিতের দিকে ঘোর-ফেরা করছিল। যে ঘরটার মধ্যে ওরা দাঁড়িয়েছিল সেটা কিছু না হলেও তিনতলা সমান উঁচু ছিল এবং সিঁড়িটা ঘুরে-ঘুরে অন্য তলাগুলো অবধি যাচ্ছিল। ঘরের একদিকে একটা বিশালাকার গ্রন্থাগার ছিল, আর অন্য দিকটা দেখে একটা মনোরোঞ্জনের স্থান বলে মনে হচ্ছিল, আর ঠিক মাঝখানটায় ছাদ থেকে একটা ভীমকায় ঝাড়বাতি ঝুলছিল।
“হে ভগবান, ওটা যেন ধপাস করে পড়ে না যায়,” হাওয়ায় উড়তে থাকা চুল ঠিক করতে-করতে সে বলল।
ঝাড়বাতিটার ঠিক নিচেই বহুমূল্য আসবাবপত্রের সাজানো বসার জায়গা ছিল। ওখানে অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যস্ত হাঁটা-চলা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, যদিও সময়টা ছিল খুব সকালবেলা। কিওকো যত দ্রুত সম্ভব এখানে চলে আসতে চেয়েছিল, আর এখন ঘড়িতে মাত্র সকাল ৭:৩০টা বাজে। কিওকো দ্রুত তার হাতে থাকা কাগজপত্রগুলোকে আরেকবার দেখে নিল, ঠিক কোথাও ওকে যেতে হবে তা নিশ্চিত করে নেবার জন্য।
ঠিক তখনই সে তার কাঁধের উপর তামার হাতের স্পর্শ পেল এবং আঙ্গুল দিয়ে তাদের সামনে থাকা সেই ঘোরানো সিঁড়িটা দিয়ে উপরে যাবার ইঙ্গিত করল। কিওকো যেহেতু স্থায়ীভাবে থাকার জন্য সেখানে এসেছিল তাই তাদের দু’জনের মাঝখানে চার-চারটি সুটকেস ছিল, আর সেগুলো বেশ ভারি-ভারিই ছিল।
তামাকে বেশ হতোদ্যম দেখাচ্ছিল। “তুই কি ইংয়ার্কি করছিস নাকি!” সবচেয়ে বড় সুটকেসটার হাতলটা একবার তুলে মাটিতে ছেড়ে দিল কারণ সে জানত ওর নিচে থাকা চাকাগুলো এবারে আর কোন কাজে আসবে না। “আমার বয়স মাত্র ১২ বছর হলেও আমি তো আর চিৎকার করে কাঁদতে পারি না।”
সে তার সংকল্পকে প্রকাশ করার জন্য নিজের কাঁধ ঝাঁকাল একবার।
ঠিক তখনই তার পিছন থেকে এক পুরুষ কণ্ঠ জিজ্ঞাসা করে উঠল, "আপনি কি মিস কিওকো হোগো?", যা তাকে একেবারে হতচকিত করে দিল।
সে দ্রুত পিছনে ঘুরে উত্তর দিল, “হ্যাঁ।”
পিছন ফিরে সে খুবই হ্যান্ডস্যাম এক পুরুষকে দেখতে পেল এবং তার চোখের মণি যেন প্রসারিত হল। তার চকমপ্রদ এক জোড়া নীল চোখ ছিল এবং লম্বা-লম্বা কালো চুল ছিল, যা পিছনদিকে পনিটেল করে বাঁধা ছিল। কিওকো যখন বিস্ময় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল তখন অদ্ভুত ঝোড়ো হাওয়া তার মুখ ছুঁয়ে বয়ে গেল। হাওয়ায় তার চুলের প্রান্তভাগ তার গাল স্পর্শ করল।
পুরষটি তার দিকে তাকিয়ে মৃদু ও আকর্ষক হাসি হাসল। তারপর, কিওকোকে আরও অবাক করে দিয়ে সেই পুরুষটি তুড়ি দিল এবং আরও দু’জন লোকে যেন শূন্য থেকে সেখানে এসে উপস্থিত হল, কিওকোর সুটকেসগুলো দেখল, এবং দ্রুত সেগুলোকে হাতে তুলে নিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে থাকল। ওদের গতিবিধ দেখে কিওকোর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছিল, কিন্তু সে মুখে কিছু বলার আগেই, সেই পুরুষটি নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে কিওকোর হাতটা ধরে ফেলল এবং নিজের ঠোঁটের কাছে টেনে এনে তার উপর কোন রাজকুমারের মতো করে চুম্বন করল।
"আমি কোতারো, আর তোমার মতো কোন সুন্দরীকে ভারি-ভারি জিনিস নিয়ে সিঁড়ি চড়তে আমি কিছুতেই দেখতে পারব না। আর এইবার তুমি যদি আমায় আজ্ঞা করো, তাহলে আমি তোমাকে তোমার ঘর অবধি ছেড়ে দিয়ে আসতে পারি।" কিওকোর হাত তার হাতের ধরেই কোতারো সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল এবং তাকে নিয়ে সিঁড়ি চড়তে শুরু করে দিল।
তার আঙ্গুলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হওয়া তাপ সম্ভবত তার বাহুর মধ্যে দিয়ে তার গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল... যা তার রক্ষকের রক্তকে উত্তেজিত করে তুলছিল। আর সেটা তাকে গোপন করতে হচ্ছিল। কোতারো এইবার কিওকোর হাতে সামান্য চাপ দিল এই ভেবে যে, এই সেই মেয়ে যার জন্য সে এতদিন অপেক্ষা করেছিল। কিওকোর ঘরের মধ্যে পা রাখতে-রাখতে কোতারোর মনে তেমন অনুভূতিই সঞ্চারি হচ্ছিল।
কিওকো তার কমনীয় ভ্রু কুঞ্চিত করে মনে-মনে হয়ত ভাবছিল, 'হে ঈশ্বর, আমাকে এই উদ্ধত পুরুষের হাত থেকে রক্ষা করো। এ আমি কোথায় এসে পড়লাম?'
কিওকো পিছন ফিরে তাকাল, আর তখনও হাঁ-করে তাকিয়ে থাকা তামার উদ্দেশ্যে একবার কাঁধ শ্রাগ করল। তারপর মাথা দুপাশে নাড়াল আর চোখের ভ্রু নাচিয়ে বলল, "তামা এরকম হাঁ-করে তাকিয়ে থেকো না, তোমার মুখে মাছি ঢুকে পড়তে পারে।" আর তারপরও তামা সম্বিত ফিরে পাবার আগেই সে আবার মাথা ঘুরিয়ে সেই তৎপর যুবকের পিছনে-পিছনে চলতে শুরু করে দিল, যার পরিচয় এখনও অবধি তার কাছে শুধুই কোতারো নামেই।
তার মনে মণিকোঠায় সে কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিল, যার মধ্যে তার ও তামার জন্য গোপন কিছু বিষয় ছিল। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে-উঠতে পিছনে সে তামার বড়-বড় নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল এবং এই সময়ে সে একটা জয়ের আনন্দ উপভোগ করছিল।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় তাদের পাশ দিয়ে আরেকটি যুবক নিচের দিকে নেমে গেল, এবং যখন সে তাদের টপকে চলে গেল তখন কিওকো তার বুকের মধ্যে একটা ক্রুশের ঝলকানি অনুভব করল এবং তার দম আটকে গেল। কিওকোর আশে-পাশের জগৎ এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেছিল যখন যুবকটি তার পাশ দিয়ে ধীর গতিতে নেমে যাচ্ছিল। তারপর যেই তার হৃদপিণ্ড আবার স্বাভাবিকভাবে স্পন্দিত হতে শুরু করল, সব কিছু আবার স্বাভাবিকভাবে প্রতীত হতে শুরু করে দিল এবং ওরা উপরে দিকে উঠে গেল।
কিন্তু ওই সময়টায় তার গোটা শরীর জুড়ে এমন এক অস্বাভাবিকতা প্রবাহিত হয়ে গেল যেন ওর কিছু খোয়া গেল... অথবা সে যেন কিছু একটা হারিয়ে ফেলল আর তার জন্য তার দারুণ অভাব অনুভূত হল। এই অস্বাভাবিক অনুভূতিকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টায় সে কে তার পাশ দিয়ে চলে গেল তা দেখার জন্য পিছন ফিরে তাকাল না। তার মনে হল এই মুহূর্তে সে না-ই বা জানল এ সব কথা।
কিওকো যে মনে-মনে বেশ মজা নিচ্ছিল তা ধরতে পেরে তামা ফিসফিস করে বলল, “যাক, এখানে আশে-পাশে তোমাকে তোষামোদ করার অনেক যুবক রয়েছে দেখে ভাল লাগল।”
সিঁড়ির একেবারে উপরে উঠে গিয়ে কোতারোর পিছনে-পিছনে একটা বড় বারান্দা ধরে এগিয়ে যেতে-যেতে কিওকো পিছন ফিরে তাকাল, যে বারান্দার দু’পাশে অনেক দরজা ছিল। তার মনে হয়েছিল এগুলোই হয় ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার ঘর, কিন্তু তারা তার কোনটিতেই দাঁড়াল না। ওই বারান্দার শেষ প্রান্তে পৌঁছে একটা দরজা সামনে এলো যার উপর মোটা হরফে লেখা ছিল প্রবেশ নিষেধ। এইবার সে কিছুটা ধন্ধে পড়ে গেল যখন কোতারো ও সুটকেস-বাহক অন্য দুই পুরুষ সেই দরজা দিয়ে স্বচ্ছন্দে ঢুকে পড়ল যেন ঘরটা তাদের, আর আরও একধাপ সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
তামা কিওকোর কাছে এগিয়ে এল এবং বলল, “আমার মন বলছে ওরা তোমাকে কোন অন্ধকূপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।”
কিওকো ওর কাঁধে হাত রেখে কিছুটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “আমরা উপরের দিকে যাচ্ছি গবেট, নিচের দিকে নয়।”
“তার মানে, ভবনের মাথায় কোন খালি ঠাণ্ডা ঘর আছে হয়ত,” তামা চটজলদি তার পিছন থেকে উত্তর দিল।
'যাই থাকুক না কেন আমি অন্তত কিছুটা ঠিকঠাকভাবে এখানে থাকতে পারব,’ কিওকো মনে-মনে এই কথা ভাবছিল যখন তারা এক প্রস্ত সিঁড়ির সামনে এসে উপস্থিত হল, তারপর তারা আরেকটা বারান্দায় এসে পৌঁছাল, কিন্তু এবারেরটা খুব সুন্দর ছিল। এর মেঝেটা শ্বেত পাথরের তৈরি মনে হচ্ছিল। দরজাগুলো একটা অপরটার থেকে অনেকটা করে দূরে ছিল। এই বারান্দায় মাত্র তিনটি ঘর ছিল, এবং কিওকো মনে-মনে কিছু উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল এই ভেবে যে, কোতারো হয়ত জানেই না শেষ অবধি তাকে কোথায় যেতে হবে।
কোতারো শেষ ঘরের দরজাটার কাছে এসে দাঁড়াল, সে মনে-মনে ভাবছিল এই মেয়েটি নিশ্চয়ই খুব বিশেষ কেউ হবে কারণ এই বারান্দায় অনেকের প্রবেশাধিকারই নেই, এবং গোটা ক্যাম্পাসের মধ্যে এই ঘরটাই সবচেয়ে ভাল ছিল। কোতারো দরজার সামনে এসে কিওকোর ও তার বন্ধুর এসে পৌঁছানো অবধি অপেক্ষা করল।
কিওকোকে কিছুটা বিক্ষিপ্ত দেখে কোতারো মুচকি হাসল। সে বুঝতে পারছিল কিওকো কিছুটা দুশ্চিন্তায় রয়েছে। সে তার চিন্তিত চোখ দুটোর উপর দৃষ্টি রাখল এবং বুঝতে পারল কিওকোর হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে, কিন্তু এই মুহূর্তে সে তাকে যা বলা হয়েছে সেটাই করতে চাইল।
সে কিওকোর দিকে তাকিয়ে তার বাহু প্রসারিত করে, হাতের তালু খুলে ইশারা করল। "এবার আমি বিদায় নেব, কিন্তু তোমার যদি কোন কিছুর দরকার হয়..." কোতারো কিওকোর হাতে সেই ঘরের চাবি তুলে দিল এবং তার দিকে এমনভাবে তাকাল যা কিওকোকে কিছুটা লজ্জিত করল, আর তারপর সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সঙ্গে থাকা দুই যুবককে তার পিছনে আসতে নির্দেশ করল।
কিওকো ও তামা উভয়েই পিছন ফিরে তাদের ততক্ষণ অবধি দেখে যেতে লাগল যতক্ষণ না তারা তাদের দৃশ্যপটের বাইরে চলে গেল, তারপর কিওকো দরজার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দরজার উপরেই একটা নামের ফলক দেখা যাচ্ছিল যাতে স্পষ্ট করে সোনালী অক্ষরে কিওকো হোগো লেখা ছিল।
তামা বোনের কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকিয়ে দিয়ে মুচকি হাসল। "এভাবে হাঁ-করে তাকিয়ে থাকলে তোমার মুখে মাছি ঢুকে পড়তে পারে।"
কিওকো এই কথা শুনে চোখ পাকাল, কারণ তার কথাই যে তার কাছে এভাবে ফিরে আসতে পারে সে তা ভাবেনি। চাবিটা দিয়ে সে ঘরের দরজার তালা খুলে আস্তে করে দরজাটাকে খুলল এবং ভিতরের দিকে তাকাল।
ঘর দেখে তামার চোখ ছানা-বড়া হয়ে গেল, আর সে কিওকোকে ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। “হতেই পারে না! এতো আমাদের গোটা বাড়িটার চেয়েও বড় একটা ঘর দেখছি।" তার বিস্ময়-মাখা শব্দ গোটা ঘরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। “তুই তো এর মধ্যেই একটা আস্ত নাচের ক্লাব খুলে ফেলতে পারিস।”
“আমার অন্ধকূপ তাহলে তোল পছন্দ হয়েছে বল?” কিওকো তার ভাইয়ের সকালের ঠাট্টার জবাব দিল।
*****
দু’ঘণ্টা পরে, তামাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার অনেক পর, কিওকো তার ঘরের বাথরুমের তাকে তার জিনিসপত্রগুলো সাজিয়ে রাখছিল। সে আবারও ঘুরে তার বাথটাবটার দিকে দেখল যেটা এতটাই বড় যে পাঁচজন একসঙ্গে চান করতে পারে।
"হতেই পারে না!", সে তার ভাইয়ের এই বিস্ময়মাখা অভিব্যক্তিটার পুনরাবৃত্তি করল।
সে তার মাথার চুল তার ঘাড় থেকে উপরের দিকে উঠে রয়েছে এমনটা অনুভব করল, এবং আবার মনে-মনে ভাল এটা হয়ত তার ভুল। “হ্যাঁ,” সে ফিসফিস করে নিজে-নিজেই বলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ত কেউ একটা আসবে এবং তাকে তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে বলবে। সে ভেবেই রেখেছিল যে, সে ভুল করে ভুল একটা ঘরে চলে এসেছে।
কিওকো বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল এবং আবারও একবার ওর ঘরের বিছানার দিকে তাকাল। বিছানাটা তার দেখা এখনও অবধি সব থেকে বড় বিছানা ছিল, আর আগে থেকেই সেটা তৈরি করা অবস্থাতেই ছিল, আরামে মোড়া কম্বল আর সব কিছু নিয়ে। অতি সুন্দর করে সাজানো ঘরটা হালকা বেগুনি আর নীল রংয়ে মোড়া ছিল, যেগুলো ঘরের কার্পেট আর বিছানার চাদরের রং। তার উপর গাঢ় লাল রংয়ের ছোপ-ছোপ ডিজাইন ছিল, এবং হারিয়ে যাওয়া যেতে পারে এত বড় একটা আলমারি ছিল।
সে আস্তে-আস্তে বসার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল যার সবকিছুই কালো আর সোনালি রংয়ের ছিল, আর তাতে সব কিছু আগে থেকে সাজানো ছিল যা একজন মানুষের প্রয়োজন হতে পারে। কিওকো আগেই তার রান্না ঘরটা দেখে নিয়েছিল। সেটা প্রয়োজনীয় সবকিছুতে ঠাঁসা ছিল। কিওকো অগুণতিবার ইতাবাচক ভঙ্গিতে তার মাথা নেড়ে গেল। "হতেই পারে না।" এখন তার ঠিক কী করা উচিৎ তাই ভাবতে-ভাবতে সে তার নিচের ঠোঁট কামড়াতে থাকে। দিনটা ছিল শনিবার, আর সোমবারের আগে তো ক্লাস শুরু হবে না।
“ভাই, গোটা দিন আমি এখানে লুকিয়ে বসে থাকতে পারব না,” সে বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করল।
অনধিকার প্রবেশ করে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন একটা ভাব নিয়ে কিওকো আস্তে-আস্তে দরজাটা খুলে মাথাটা বের করে বাইরের বারান্দাটার দিকে তাকাল। কাউকেই না দেখতে পেয়ে, সে ঘর থেকে বেড়িয়ে ঘরের দরজাটা দিয়ে দিল, তারপর গুটি-গুটি পায়ে যে সিঁড়িটা নিচের দিকে চলে গেছে সেটার দিকে এগিয়ে গেল।
আর তখনই আবারও তার মনে হতে লাগল কেউ তাকে দেখছে, আর তাতেই তার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল, কিন্তু সে হাঁটা থামালো না, যদিও পিছন ফিরে দেখার সাহসও করল না।
‘ও আমাকে অনুভব করতে পারছে,’ কিউ মনে-মনে ভাবল। ওর শক্তি হয়ত ততটা গভীরে গেঁথে যায়নি যতটা সে মনে করছিল। ঘর থেকে বেরোবার সঙ্গে-সঙ্গেই সে সেটা অনুভব করতে পেরেছিল আর সে তার সুগন্ধও পেয়েছিল... তার আস্বাদ গ্রহণ করেছিল।
তার সুগন্ধের স্মৃতি অন্যান্য সমস্ত স্মৃতিকেই তাজা করে দেয়। "ঋত্বিকা, আমরা শীঘ্রই তোমার শক্তি আবার ফিরিয়ে আনব। তুমি তা লুকিয়ে রাখতে চাইতে পার... কিন্তু বেশি দিন তুমি তা পারবে না।" বারান্দার দেওয়াল থেকে সে ঝুঁকে দেখছিল, তার সোনালী চোখ কিওকোকে ততক্ষণ অবধি অনুসরণ করল যতক্ষণ সে দৃষ্টির বাইরে চলে না গেল।
*****
নিচে নেমে কিওকো যেন একটু হাঁফ ছাড়ল। এখন সে এখানে তার বয়সের অনেক ছেলে-মেয়েকে দেখতে পেল। উপরের তলার সমস্ত বিস্ময় ও বিহ্বলতা এক দীর্ঘশ্বাসে ঝেড়ে ফেলে কিওকো এখানে যেন নিজের জন্য আলাদা করে কিছুটা মুহূর্তের সন্ধান পেল।
নিজের চেতনা যখন কাউকে বিহ্বল করে তোলে তখন তা থেকে নিজেকে মুক্ত করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় তার মনে হয় তার এই ধরনের চেতনা একেবারেই না এলে সে হয়ত শান্তিতে বাঁচতে পারে। ভবনের এক তলার এই বিরাট হল ঘরে এসে সে তার মনের মধ্যে চলে আসা সেই সব চেতনাকে মনের সুদূর কোণে ঠেলে দিল। “এটা চালু ও বন্ধ করার একটা সুইচ পেলে ভাল হত,” সে বিড়বিড় করে বলল, কিন্তু সাথে সাথে একটু আগেই মনের মধ্যে যে অদ্ভুত কম্পণ হচ্ছিল তাকেও অনুভব করতে পারছিল।
সে গ্রন্থাগারের দিকে তাকাল, আর তারপর দ্রুত পিছন ফিরে ওদিকটা দেখে নিল। সে আসলে গোটা জায়গটা সম্পর্কে ভালভাবে জেনে-বুঝে নিতে চাইছিল। সে যতদূর মনে করতে পারে, শারীরিক কসরত করে চলাটা তার অভ্যাসের একটা অংশ এবং এখানেও সে তার বাইরে থাকতে রাজি নয়। গত দু’বছর ধরে সে সব ধরনের মার্শাল আর্ট শিখছিল, এবং এর ফলে তার গোটা শরীরে যে ধরনের স্বাচ্ছন্দ এসেছিল তা তার খুবই পছন্দের ছিল।
বিনোদনের ঘরগুলো পেরিয়ে গিয়ে সে একাধিক শারীরিক কসরতের জায়গা বা জিম দেখতে পেল। এগুলোর মধ্যে বড় একটা জিমের একটা কাঁচের দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে বাইরেটা দেখা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে ওই কাঁচের দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য বাইরের দৃশ্যটা না দেখে সে পারল না। ও পাশে দু'জন লোককে দেখা যাচ্ছিল যারা তলোয়ার লড়াইয়ের মতো কিছু একটা করছিল। দুটি ধাতব জিনিসের মধ্যে আঘাতে তৈরি হওয়া শব্দ কানে আসায় সে তার চোখের ভ্রু তুলে তাকাল। দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে সে কান খাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করল।
"তুমি কিন্তু মনোযোগ দিচ্ছ না, সুকি" কালো রংয়ের পোশাক পরা একটা লোক পুরষ কণ্ঠে তার নিচে থাকা একজনের আক্রমণ ঠেকাতে-ঠেকাতে এই কথাগুলো তাকে বলছিল।
কিওকো কারোরই মুখ দেখতে পাচ্ছিল না কারণ তারা উভয়েই মুখে এক ধরনের রক্ষাকবচ পরে ছিল।
"শিনবে!" ক্রুদ্ধ মহিলা কণ্ঠ শোনা গেল। আর তারপরই কোন প্ররোচনা ছাড়াই ওই ব্যক্তি আঘাত হানল এবং তার মাথায় আঘাত করল, অনেকটা একটা বেতের তলোয়ার দিয়ে, আর তাতেই তার মাথার ঢাকনাটা খুলে গেল।
ঢাকনার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা লম্বা বাদামী রংয়ের চুলের ঢল দেখে কিওকো অবাক হয়ে গেল, যে সঙ্গে-সঙ্গে নিচে থেকে তার উপরে থাকা পুরুষটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল এবং ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়াল। "এত লেকচার দিলে মনোযোগ দিয়ে লড়া যায় না।”
শিবনে হাসতে-হাসতে তার মাথার পুরো রক্ষাকবচ খুলে ফেলল। হাল ছাড়ার ভঙ্গিতে সে তার বাহু দুটো উপরে তুলে ধরে পিছিয়ে গেল। "আমি দুঃখিত, সুকি কিন্তু এটাই আমি বলছিলাম... তুমি ঠিক মতো আত্মরক্ষা করছিলে না।" শরীর জুড়ে একটা ঝনঝনানির প্রবাহ অনুভব করে সে ভ্রু কুঁচকে তাকাল, আর তারপর দরজায় দাঁড়ানো মেয়েটির উপর তার নীল চোখের দৃষ্টি রেখে সে বলে উঠল, “আহা, আমাদের একজন দর্শক রয়েছে মনে হচ্ছে।”
কিওকো দেখল সুকি নামে যে মেয়েটাকে ডাকা হচ্ছিল সে কিছুটা লজ্জিত দৃষ্টিতে তার প্রতিপক্ষের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর পিছন ফিরল এবং মুখে চওড়া হাসি নিয়ে তার দিকে এগিয়ে এল।
"এই যে,” বলে সুকি পুরোন বন্ধুর মতো করে তার হাত দুটো বাড়িয়ে দিল, "আমার নাম সুকি, আর আমার থেকে কৈফিয়ৎ চাওয়া এই লোকটা হল শিনবে,” বলে তার বুড়ো আঙ্গুলটা পিছনে ইঙ্গিত করে তার পিছনে মুচকি হাসি হাসতে-হাসতে এগিয়ে আসা পুরষটিকে দেখাল।
“সুকি,” শিনবে বলে যার পরিচয় দেওয়া হল সেই যুবক বলল। “তুমি আমাকে হঠাৎ করে আমাকে আঘাত করেছিলে।” এই বলে সে তার হাত দুটো নিজের বুকের উপর রেখে তার কথার সত্যতা বোঝাতে চেষ্টা করল।
তা শুনে সুকি ভ্রু কুঁচকে বলল, “শিনবে… আমি যদি তোমাকে সত্যিই আঘাত করতাম তাহলে এতক্ষণে তোমার মাথাক ঘিলুটা তোমার কান দিয়ে বেরিয়ে যেত।”
শিনবেও তার ভ্রু ততধিক বিস্ময়ে কুঁচকে বলল, “তুমি জান আমি তোমার রুক্ষ ভালবাসা পেতে ভালবাসি।”
“আমি এক্ষুণি তোমাকে সেই রুক্ষ ভালবাসা আবার দিতেই পারি, কিন্তু আমি এই নতুন মেয়েটাকে তা দিয়ে ভয় পাইয়ে দিতে চাইছি না,” সুকি চকিতে উত্তর দিল।
এরই মধ্যে কিওকোর ওকে পছন্দ হয়ে গেছে, আর তাই সুকির বাড়িয়ে দেওয়া হাত সে জোরে চেপে ধরল এবং হাসল। "আমার নাম কিওকো হোগো, কিন্তু তোমরা আমাকে শুধুই কিওকো বলতে পারো।"
সুকির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে সে তাকাল। “তোমাদের দু’জনের সঙ্গেই মিলিত হয়ে খুব ভাল লাগল।” ওই যুবকের চোখে কিছু একটা ছিল যেটা কিওকোর মনোযোগ আকর্ষণ করল। চোখ দুটির রং অসাধারণ নীল এবং খুবই মনোরম ছিল। তার মাথার চুল তার কাঁধেরও কিছুটা নিচে নামে এবং তা ঘন কালো এবং তাতে নীল হাইলাইট রয়েছে। তার চেহারা-ছবি কিওকোকে কিছুটা ৮০-র দশকের রক গায়কদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
সুকির মুখে চওড়া হাসি ছিল। "আমি কিন্তু তোমার ব্যাপারে শুনেছি। হ্যাঁ, আর আমি এ-ও জানতাম যে, তুমি আজ আসছ। আমি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার খোঁজে বেরোতাম এবং তোমাকে ঠিক খুঁজে বের করে নিতাম।” সুকি হঠাৎ করে ওর মুখের দিকে একটু কাতর দৃষ্টিতে তাকাল এবং তার মাথাটা একদিকে ঘুরিয়ে শিনবের উপর দৃষ্টি রেখে বলল, “তোমার জায়গায় আমি হলে আমি তা করব না।”
কিওকো তার মাথা কাত করে দেখল। অবশ্যই... ছেলেটার হাত মাঝ পথে থেমে গেছিল, যা সুকির পিছনটা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছিল, এবং সে দুষ্টুমি-মাখা হাসি হাসছিল।
শিনবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের হাতটা নামিয়ে নিল, “ পিছনে না দেখেও তুমি কীভাবে বুঝতে পার একদিন আমি তা ঠিক ধরে ফেলব।”
সুকি গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমি এটা পারি, আর সেটাই সব!” কিওকোর দিকে মিষ্টি হাসি নিয়ে তাকিয়ে সে বলল, “আমার সঙ্গে চলো, আমি এক সেকেন্ডের মধ্যে জামা-কাপড় বদলে নিচ্ছি।” সে কিওকোর হাতটা ধরে তাকে টেনে দরজার বাইরে নিয়ে চলে গেল।
কিওকো পিছন ফিরে শিনবের দিকে তাকাল যে তাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছিল। ‘এই দু’জনের সাথে প্রচুর মজা করা যাবে,’ এই ভাবতে-ভাবতে সে সুকির সাথে মহিলাদের লকার রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
সুকি ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছিল যে সে কিওকোকে পছন্দ করে, এবং যে কোন কারণেই হোক, তার মনে হয় সে কিওকোকে জানে, এমনকি আগে কখনও তার সঙ্গে মিলিত না হয়েও। “আমি পোশাক বদলাতে-বদলাতে তুমি বরং তোমার ব্যাপারে কিছু বল,” এই বলে সুকি তার জামা-কাপড় নিয়ে দেওয়ালের আড়ালে চলে গেল।
সুকির সঙ্গে পুরোপুরি স্বচ্ছন্দ বোধ করায় কিওকো আরাম করে সেখানে থাকা বেঞ্চিতে বসল। “দেখো, আমি এই শহরের অপর প্রান্তের একটা ছোট্ট শহরতলি থেকে আসছি। আর যে কোন কারণেই হোক, খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে, আমি একটি চিঠি পাই যাতে এখানে ছাত্রবৃত্তি, মানে স্কলারশিপ, পাবার কথা লেখা ছিল।” ওপাশ থেকে সুকির “হুম” শুনতে পেয়ে কিওকো বলে চলল। “আমি জানি না এই স্কলারশিপ আমি কীভাবে পেলাম, আমি তো এর জন্য আবেদনও করিনি কখনও।”
সুকি তার এই কথার মধ্যেকার জিজ্ঞাসা অনুভব করতে পেরে দেওয়ালের পিছন থেকে মুখ বের করে একটু হাসল। “ওটা নিয়ে ভেবো না। তুমি যেভাবে এসেছো আমিও সেইভাবেই এখানে এসেছিলাম।” “আমি কখনোই এখানে ভর্তির আবেদন করিনি,” এই কথা বলে সুকি আবার দেওয়ালের পিছনে চলে গেল।
কিওকোর ভ্রু কুঞ্চিত হল, “কিন্তু কেন? কোন কারণ তো থাকতেই হবে। তোমার জানা আছে কি সেটা?"
সুকি তার পোশাক বদলে বাইরে বেরিয়ে এল। সে তার টেনিস জুতো পরার জন্য বেঞ্চিতে বসল। “হ্যাঁ, আমি ব্যাপারটা ধরতে পেরেছি। পুরোটা না হলেও কিছুটা তো বটেই। এই স্কুলটার অধিপতি সেই সব লোকেদের খোঁজে থাকে যারা...” সুকি একটু থামল, তারপর মাথাটা কিওকোর দিকে ঝুঁকিয়ে বলল, “...অনন্য ক্ষমতার অধিকারী।” সেই সঙ্গে কাঁধ ঝাঁকিয়ে এ-ও বলে দিল, “তুমি যখন এখানকার অন্যান্য আবাসিকদের সঙ্গে মিলিত হবে তখন এরকম অনেক কিছুর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।” সে মুচকি হাসল, যার ভাবটা এরকম যে, সে যা জানে সেটা ঠিক।
সুকি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল এবং লকারের দরজার উপর একটা জুতো ছুড়ে মারল, আর কিছুটা জয়ের হাসি হাসল যখন দরজার ওপার থেকে কাউকে গালাগাল দিতে শোনা গেল। সুকি জুতোটা কুড়িয়ে নিয়ে এসে সেটাকে পায়ে বাঁধতে লাগল। “এইবার বলো, তোমার মধ্যে অনন্য কী ক্ষমতা রয়েছে?”
কিওকোর মস্তিস্কে এত রকম কিছু চলছিল যে ক্লান্তিতে তার প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এখানে কোনভাবেই কেউ এ কথা জানতে পারে না সে একজন ঋত্বিকা। সে ভ্রু কুঁচকে সুকির দিকে তাকাল এবং দ্রুত চারিদিক একবার দেখে নিয়ে উত্তর দিল, “আমার তো তেমন কিছু আছে বলে জানা নেই।”
সুকি তার এক চোখে ভ্রু তুলল, যা অবিশ্বাসের পরিচায়ক, কিন্তু তারপরই তার কাঁধ এমন ভঙ্গিতে ঝাঁকালো যার মানে এই হয় যে, সে আজ না হোক কাল তার হদিশ লাগিয়েই ফেলবে। “চলো, এবার যাই। শিনবে হয়ত আমাদের জন্যই অপেক্ষা করে রয়েছে।” সে দরজাটা খুলল এবং দেখল তাই-ই, শিনবে দরজার ঠিক বাইরেই দাড়িয়ে রয়েছে, এবং সে এতটাই কাছে ছিল যে, সে হয়ত ওদের কথাগুলো শুনতেও পাচ্ছিল। সে ওদের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসল এবং কিছুটা পিছনে পিছিয়ে গেল।
ওরা বাইরে বেরিয়ে এসে সুকি দরজাটা বন্ধ করে দিল এবং দরজায় লেখা বোর্ডটার দিকে তর্জনী নির্দেশ করল। "শিনবে, ওটা পড়োনি তুমি? ওটাতে মহিলাদের লকার রুম কথাটা লেখা আছে।” এই বলে সুকি ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।
শিনবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, সেই জন্যই তো আমি ওর বাইরেই দাড়িয়েছিলাম।” সুকি ওর দিকে সজোরে হাত ছুড়লে শিনবে দ্রুত তাকে পাশ কাটাল। “সুকি... আমি একটা ছেলে... আমার স্নেহ-ভালবাসার দরকার। আর সেটা পাবার জন্য এর থেকে ভাল উপায় আর কী হতে পার যে, আমি এ ব্যাপারে জানবার চেষ্টা করি যে মেয়েদের মস্তিস্কে কী চলছে?”
“তুমি লাইব্রেরিতে গিয়ে তোমার গবেষণা চালাতে পারো,” সুকি দাঁত কিড়মিড় করে তাকে বলল।
শিনবে মুচকি হাসল। “দেখো সুকি, ওই লাইব্রেরিতে রাখা মেয়েদের মন সংক্রান্ত সমস্ত বইগুলোর পাতাই... একেবারে খালি।”
সুকি হেসে ফেলল, “তার কারণ, লাইব্রেরির ওই বইগুলো সবই কোন না কোন ছেলের লেখা।”
সুকির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে শিনবে ওর দিকে ঝুঁকে বলল, “ঠিক তাই। আমি সেই প্রথম ব্যক্তি হতে চাই যে এমন বই লিখবে যা আমাদের, মানে টেস্টোস্টেরন বহনকারী পুরুষ জাতিকে কাজের কথা জানাবে।”
সুকি দ্রুত একবার কিওকোর মুখের দিকে তাকাল, আর তারপর নিজের হাতঘড়িটার দিকে দেখল। "কি, তোমার কি খিদে পেয়েছে? চলো, স্টুডেন্ট রেস্তোরাঁয় যাই, গিয়ে আগে কিছু খাই।”
কিওকো মাথা নাড়ল। কিওকো সকাল থেকে এতটাই নার্ভাস ছিল যে কিছু খাবার কথা তার মনেই ছিল না, কিন্তু এই দুজনের সঙ্গে সে কিছুটা বাড়ির লোকের মতো অনুভব করছিল, আর তাই এইবার তার খিদে পেল।
শিনবে তার একটা হাত তুলে বলে উঠল, “লেডিজ ফার্স্ট।” এই সময় সুকি তাকে তার মাথায় সজোরে একটা ঘুঁষি বসিয়ে দিল আর শিনবে চিৎকার করে উঠল।
“আগেরবার তোমায় মারতে পারিনি... এবার আগে চলো,” সুকি অভিযোগী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল। শিনবে তাদের আগে-আগে চলা শুরু করলে, সুকি মুখে মুচকি হাসি নিয়ে কিওকোর দিকে ঝুঁকে বলল, “সব সময় ওকে তোমার সামনে রাখার চেষ্টা করবে, না হলেই তোমাকে খারাপ লাগার ঝামেলা সহ্য করতে হবে কিন্তু।”
কিওকো আর না হেসে সে পারল না। কিওকোর হাসি শুরু হল আর থামতেই চাইল না যতক্ষণ না তারা ওর মধ্যেই থাকা খাবার ঘরের মধ্যে পৌঁছাল, যেটা কিওকোর কাছে খাবার হোটেলের মতো লাগল। সে যতই সুকির কাছে এগিয়ে গেল তার চোখে প্রসারিত হতে থাকল। “বুঝলে, আমি যতবার এখানে আসি আমার মনে হয় আমি ভুল জায়গায় চলে এসেছি।”
শিনবে তাদের ওই ঘরের পিছনের দিকের একটা টেবিলে নিয়ে গেল। সুকি আর কিওকো টেবিলের একদিকের বেঞ্চে বসল আর শিনবে অপর দিকের বেঞ্চটায়, ওকে এমন দেখাচ্ছিল যেন ও বিশ্বের সবচেয়ে নিরীহ একটি ছেলে। “বুঝলে, এই জায়গাটায় অভ্যস্ত হতে কিন্তু বেশ সময় লেগে যাবে।” এই বলে শিনবে কিওকোর দিকে তাকিয়ে হাসল এবং ওর নীল চোখ দুটোকে যেন প্রজ্জ্বলিত করল। “আমি এক বছর হয়ে গেল এখানে এসেছি, কিন্তু এখনও এখানটায় ঠিক মতো অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি।”
সুকি কিওকোর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল, “ও সেইভাবেই এখানে এসেছে যেভাবে আমি আর তুমি এখানে এসেছি। একটা খোলা আমন্ত্রণ পেয়ে।” এই তথ্য দিয়ে ও এমন ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালো যেন ও কিওকোকে বলতে চায় ওর ব্যাপারটাকে এবার মেনে নেওয়া উচিৎ এবং আনন্দে থাকা উচিৎ।
কিওকো কিছুটা বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে সুকির দিকে তাকাল, “ঠিক বুঝলাম না। এদের এরকম করার কারণটা কী?"
শিনবে এমনভাবে তার মাথটা নাড়ল যেন সত্যিটা কী তা কারুর তাকে বুঝিয়ে বলা উচিৎ। “আমার নির্দিষ্ট কিছু ক্ষমতা রয়েছে, সুকিরও তা রয়েছে।” এই বলে শিনবে কিওকোর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে কাঁধ ঝাঁকালো। “স্কলারশিপ নিয়ে এখানে পড়তে আসা সবারই রয়েছে।” তারপর সঠিক শব্দটা চয়ন করার জন্য সে কিছুটা থামল এবং তারপর বলল, “আমাদের সকলেরই কোন না কোন বিশেষ প্রতিভা রয়েছে।” এই বলে সে সুকির দিকে তাকিয়ে এক চোখের ভ্রু তুলল, "তুমি এখনও ওকে বলোনি কিছু?"
সুকি দ্রুত মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল ও বলেনি এবং তারপর কিওকোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই বিষয়টা বদলাতে চাইল, “তোমরা কি চাই, হ্যামবার্গার আর ফ্রাই?”
কিওকো মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, আর সুকি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল, ঠিক যেন ও ফ্রি স্কলারশিপের বিষয় নিয়ে আর কোন প্রশ্ন এড়াতে চাইছিল, “আচ্ছা, বসো, আমি এক্ষুণি আসছি, ঘাবড়াবার কিছু নেই। যারা স্কলারশিপ পেয়ে এখানে আসে তাদের জন্য খাবার-দাবার ফ্রি আর ওরা সেগুলি আমাদের কাছে পৌঁছেও দিয়ে যায়।” সুকি শিনবের সঙ্গে কিওকোকে রেখে অর্ডার দিতে চলে গেল।
অধ্যায় ৩ "তয়ার সঙ্গে দেখা হওয়া"
শিনবে খুব গুরুগম্ভীর দৃষ্টি নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকল, ওর নীল চোখ দুটো জ্বল-জ্বল করছিল, “এখানে স্বাভাবিক মানুষজন রয়েছে, আবার সেই সব ছাত্র-ছাত্রীরাও রয়েছে যারা স্কলারশিপ পেয়ে এখানে এসেছে, যেমন আমি আর সুকি। স্কলারশিপ পাওয়া আরও ছাত্র-ছাত্রীও আছে কিন্তু আমাদের সকলের মধ্যেই কিছু বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে... যেমন, এমন কিছু ক্ষমতা যেটা আর পাঁচটা সাধারণ লোকের মধ্যে থাকে না।”
“আমার মধ্যে যা রয়েছে তা হল টেলিকাইনেসিস। আমি আমার মানসিক শক্তি দিয়ে পার্থিব বস্তু নাড়াচাড়া করতে পারি।” “আর রয়েছে টেলিপ্যাথি, যার মানে হল, আমি আমার মনে মনে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারি।” এই কথাগুলো সে কোন শব্দ উচ্চারণ না করে বলল, তার সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে যা দিয়ে সে মনে মনে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারত।
কিওকোর মুখ হাঁ হয়ে গেল যখন সে বুঝল যে শিনবের ঠোঁট নড়ছে না কিন্তু তার কথাগুলো কিওকোর মাথার মধ্যে বাজছে। সে হঠাৎ করে নিজের মধ্যে কিছুটা উষ্ণতা অনুভব করল যেন শিনবের অন্তর থেকে বেরোন কথাগুলো তার মধ্যে রয়েছে... বা ওইরকম কিছু। কিওকোর ভাব-ভঙ্গি শান্ত হয়ে উঠল এবং শিনবের দিকে তার দৃষ্টি নরম হয়ে এলো।
শিনবে তারা ভ্রু কুঁঞ্চিত হওয়া এড়াতে চাইল... যখন সে কিওকোর মনের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করেছিল... সেটা তাকে করতে হচ্ছিল কারণ এর জন্য তার সমস্ত মনঃসংযোগ তাকে একত্রিত করতে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন তার শক্তি কিওকোর মধ্যেই সে রাখতে চাইছিল। সে তার সেই অনুভূতিকে কিছুটা নাড়িয়ে দিতে তার কথা চালিয়ে গেল। “এছাড়াও আমার মধ্যে সম্মোহন করার ক্ষমতাও রয়েছে এবং আমি বৌদ্ধ সন্যাসীদের দীর্ঘ বংশপরম্পরা থেকে এসেছি।” সে থেমে গেল যখন কিওকো হো-হো করে হেসে উঠল।
সুকি ফিরে এসে কিওকোর পাশে বসতে-বসতে বলল, “আমি জানি ওর কথাগুলি বিশ্বাস করাটা কঠিন, কিন্তু এটা সত্যিই যে ও বৌদ্ধ সন্যাসীদের বংশদ্ভুত।” এই বলে সুকি একটু দুষ্টুমি মাখানো হাসি হাসল আর তারপর আবার মুখের ভাব শান্ত করে নিয়ে বলল, “আমি ওকে কোন জিনিস না ছুঁয়ে ছুঁড়ে ফেলতে দেখেছি, আর সেই সঙ্গে ও প্রায় সব ধরনের মার্শাল আর্টেই বেশি পারদর্শী।”
“কিওকোকে আমার দুর্দান্ত সব প্রতিভাগুলোর সবকটাই বোধহয় জানিয়ে রাখা ভাল,” শিনবে সুকির সাথে সাথেই যোগ করল।
এটা শুনে সুকি শিনবের দিকে তাকিয়ে চোখা পাকাল, “না, তুমি যে ওটাও ভাল পারো, সেটা কিন্তু আমি ওকে বলতে পারব না!” এই বলে ও শিনবের মাথায় একটা চাঁটি কসিয়ে দিল।
“কিন্তু তারপরেও ও একজন মানুষের মতোই আচার-আচরণ করে,” হঠাৎ করেই প্রায় শূন্য থেকেই একটা কণ্ঠ ভেসে এল এবং শিনবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওই কণ্ঠের দিকে নিজের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করল।
কিওকো চোখ তুলে তাকালো এবং ওর চোখ একজোড়া সোনালি চোখে আটকে গেল। ওই কণ্ঠস্বরের মালিক এতটাই সুদর্শন ছিল যা কিওকো আগে কখনও দেখিনি। লম্বা-লম্বা কালো চুল, রূপালি হাই-লাইট করা, যা কপাল থেকে লম্বা-লম্বা পরতে নিচে নামছিল। তার ত্বকে একটা অস্বাভাবিক জেল্লা ছিল এবং তার দেহের গঠন ছিল ঈর্ষণীয়। তার চোখ দুটো যেন কিওকোর চোখ দুটিকে বেঁধে ফেলেছিল যদিও সে সরাসরি কিওকোর দিকে তাকিয়ে ছিল না।
সুকি কিছুটা রাগের ভঙ্গিতে নিজের হাত দুটোকে নিজের বুকের কাছে টেনে তার দিকে বিরক্তম-মাখা দৃষ্টিতে তাকাল। “ব্যস, তুমি থাকলে ওকে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে আর কাউকেই দরকার হবে না।”
শিনবে সুকির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কিওকোকে বক্তার পরিচয় দিল, “ওর নাম তয়া। তয়া, ও হল কিওকো। এখানে আজই ওর প্রথম দিন।”
তয়া কিওকোর দিকে ঘুরে তাকাল, এবং যে কোন কারণেই হোক যেভাবে তয়া ওর দিকে তাকাল, যেন ওকে মাপছে, তাতে কিওকো কিছুটা বিরক্ত হল। কিওকো চোখের দৃষ্টি সংকীর্ণ হল, এবং প্রথম দেখার ছাপটা তার মধ্যে দেখে যেন উবে গেল।
"আচ্ছা, তুমিই তাহলে সেই ঋত্বিকা।?" তয়া কিছুটা নিরুদ্বেগে বলল এবং ওর দিকে থেকে মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে, যেন ওকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে, বসে পড়ল।
কিওকোর চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাল এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওখানে কেউ-ই জানত না ও কিওকো একজন ঋত্বিকা। সত্যি কথা বলতে, ওর খুব কাছের পারিবারিক সদস্যরাই শুধু জানত বিষয়টা।
“তুমি এটা কীভাবে জানলে,” কিওকো হঠাৎ করে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে তয়ার কাছে জানতে চাইল।
ওকে এভাবে ক্রুদ্ধ হতে দেখে তয়া কিছুটা রেগে গেল। “এরকম পাগলের মতো চেঁচামেচি কোর না তো। আমি আস্তে বললেও ভালই শুনি,” তয়া রাগত কণ্ঠে ওকে বলল।
কিওকো আর তয়াকে এভাবে একে-অপরের বিরুদ্ধে খর্গহস্ত হতে দেখে সুকি ও শিনবে দু’জনেই কিছুটা থমকে গেল।
তয়ার চেতনায় শক্তি-প্রবাহিত হতে শুরু করল যেই মাত্র কিওকো তার সাথে ক্রুদ্ধ স্বরে কথা বলল, এবং সে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠল, এই ভেবে যে, কিওকোর ছোট-খাটো শরীরটায় নিশ্চয়ই বড়-সড় কোন শক্তি নিহিত আছে, যদিও সে কোনভাবে সেটা কিওকোর সামনে প্রকাশ করতে চাইছিল না।
নিঃশব্দে হলেও কিওকোর চেহারা-ছবির প্রশংসা তার মধ্যে ছিল। কিছুটা হৃদয়ের আকারের তার মুখের দু’পাশ থেকে তার সোনালি চুলগুলো এপাশ থেকে ওপাশে উড়ছিল। কিওকোর চঞ্চল সবুজাভ চোখ দুটো তার দিকে সরাসরি তাকিয়েছিল, যেটা তাকে হয় কিছুটা হলেও উত্তেজিত করে তুলেছিল। মেয়েদের মধ্যে থাকা আগুন সে পছন্দ করত এবং কিওকোর মধ্যে আগুনের অভাব ছিল না, কিন্তু যে কোন কারণেই হোক এ যাত্রায় সেটাই তাকে কিছুটা ধৈর্যচ্যুত করেছিল। কিওকো যেভাবে তার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিল সেটা তার পছন্দ হয়নি... সে সেটার দ্রুত মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছিল।
সে কিওকোর থেকেও কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল, তাকে কিছুটা ত্রস্ত করে দেবার চেষ্টা করল। “তুমি তো স্কলারশিপ পেয়েছে, তাই না... আর ও বলল তুমি নাকি একজন ঋত্বিকা!” তয়া তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গজগজ করতে-করতে কথাগুলো বলল, এতটাই কাছে গিয়ে যেন আরেকটু হলেও কিওকোর নাকে ওর নাক ঠেকে যাবে। সে হাত দুটোকে কিছুটা ভাঁজ করে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে গর্জন করল। “আমি বাজি ধরে বলতে পারি দৈত্য কাকে বলে তুমি তা-ই জানো না,” সে গজগজ করে বলল, আর তখনই সে বুঝতে পারল তার তর্জন-গর্জন সত্ত্বেও কিওকো ক্রমশই আরও সুন্দরী হয়ে উঠছে, আর তাতেই সে কিছুটা বিব্রত হল।
কিওকোও থতমত খেয়ে গেল, তারও রক্ত ফুটতে শুরু করল। সে জানত দৈত্য কেমন হয়। সে সারা জীবন এই সব নিয়ে পড়াশোনা করেছে এবং তার পরিবারের লোকেরা যদি ঠিক হয় তাহলে কিছু দৈত্যের সঙ্গে তার সাক্ষাতও হয়েছিল... কিন্তু তার সে কথা মনে নেই। তা হলেও, তয়ার তার প্রতি এই উদ্ধত আচরণ তার একেবারেই ভাল লাগল না, তাই সে তয়ার দিকে চোখ রেকে তার ভ্রু নাচিয়ে তাকে যেন ইশারায় বলতে চাইল সে বাজি ধরতে সত্যি-সত্যিই প্রস্তুত তো।
সুকি আর থাকতে না পেরে কিওকোর সমর্থনে মুখ খুলল, “তয়া, এত অভদ্রের মতো আচরণ করছ কেন? ও মাত্র কয়েক ঘণ্টা হল এখানে এসেছে, আর তুমি ওকে এখান থেকে তাড়িয়ে দেবার আগেই আমি ওকে আমাদের সঙ্গে থাকার অনুরোধ করতে চাইব।” কিওকোকে এতো দ্রুত হারাতে হবে এই চিন্তা থেকে সুকিকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।
তয়া বিরক্ত হয়ে তার চোখের ভ্রু তুলে সুকির উদ্দেশ্যে বলল, “দেখ, ও এখনও আমার প্রশ্নের কোন উত্তর কিন্তু দেয়নি। তোমার কি মনে হয় ও এসব সামলাতে পারবে?" এই বলে সে আবার কিওকোর দিকে ফিরে তাকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকল।
“তোমার যা ইচ্ছে করতে পার, আমি তার সবই সামলাতে পারব, গাধা,” কিওকো এক নিঃশ্বাসে উত্তর দিল, ওর গলা কঠিন হয়ে উঠছিল।
সুকি আর শিনবে একে-অপরের দিকে তাকাল। তারা তাদের নিজেদের ছাড়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিপতি ছাড়া অন্য আর কাউকে তয়ার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে শোনেনি, আর হয়ত কোতারো ছাড়া। এই সব দেখে তারা দু’জনেই বেশি আমোদিত হল, আর ভাবল, এই কিওকো নামের মেয়েটিকে তাদের ভাল না লাগার কোন কারণ নেই।
এর মধ্যে একজন ওয়েটার কিছু খাবার-দাবারের ট্রে হাতে নিয়ে তাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল, এবং কিওকো তয়ার দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে তার দিকে নজর দিল। ছেলেটি তার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল, আর তাতেই কিওকোর মনে হল কিছু একটা ঘটতে চলেছে। সে ছেলেটির কালো চোখ দুটিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল যেগুলি তার বালক-সুলভ মুখের সঙ্গে কিছুটা বেমানান লাগছিল।
তয়ার মধ্যেকার কোন একটি বিষয় কিওকোকে আকর্ষিত করছিল... যদিও সেই অনুভূতিটা সত্যিই তার ভাল লাগছিল কিনা তা সে বুঝতে পারছিল না। তয়াকে দেখতে খুবই আকর্ষক তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তার বাইরেও কিছু একটা কিওকোকে কিছুটা হলেও অপ্রস্তুত করে তুলছিল। এই তরুণের মধ্যে থেকে একেবারে অনায়াসেই নিঃসারিত হওয়া সেই মায়াজাল ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টায় কিওকো তার চোখের পলক ফেলল। বাতাবরণটা দ্রুত বদলে গেল যখন কিওকোর ঠিক পাশ থেকেই প্রায় গর্জনের মতো একটা শব্দ তার কানে এল।
তয়া তার শরীরে ঠাণ্ডা কোন কিছু আঁকড়ে ধরে ওঠার অনুভূতি পাচ্ছিল আর তাতেই সে সেই ছেলেটার উপর গর্জন করে উঠেছিল, যে তাকে তার হতবুদ্ধি অবস্থা থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনার জন্য একটু ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল। এই অবস্থায় ছেলেটি যখন তয়ার চোখে চোখ রাখল তখন তার চোখ দুটি নিকষ কালো থেকে রূপালী-নীল রংয়ে পরিবর্তিত হয়ে গেল এবং সে ঘুরে দাঁড়িয়ে টেবিল ছেড়ে চলে গেল।
কিওকো বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে সুকির দিকে তাকাল, কিন্তু সুকি তাতে কোন পাত্তাই না দিয়ে নিজের কাঁধ একবার ঝাঁকিয়ে তার সামনে রাখার খাবারগুলোতে মন দিল। কিওকো ছাড়াও শিনবেও বেশ হতচিকত হয়েছিল এবং সে তার বিহ্বলতা ঢাকার জন্য কাশার মতো করে তার মুখের সামনে তার হাত রেখে গোটা ঘরটার মধ্যে দ্রুত হেঁটে-চলে বেড়ানো যুবকটির দিকে তাকিয়ে রইল। ‘তয়া’ নামক এই যুবকটির মধ্যে থেকে এক অদ্ভুত ধরনের আবহ কিওকোর মধ্যে প্রবেশ করছিল এবং ব্যাপরটা ঠিক কী তা উদ্ঘাটন না করা অবধি সে নিজেকে শান্ত করতে পারছিল না। সে নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে যুবকটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে বুঝতে চেষ্টা করল।
তার লম্বা-লম্বা চুলের ছিল রাতের সবচেয়ে অন্ধকারতম অংশের চেয়েও কালো যাতে আবার রূপালী হাইলাইট করা ছিল, আর তার চোখ দুটি ছিল অসাধারণ সুন্দর... সে খুব সুন্দর ছিল। 'নিজের প্রতি মনের নিভৃত উক্তি, এভাবে ভাবার জন্য নিজেকে একটা চড় কষাও।' ওর চোখ দুটি উজ্জ্বল সোনার মতো, কোন সন্দেহই নেই। ও যেভাবে কিওকোকে দেখেছিল তা যদি না করত তাহলে ও হয়ত তার কাছে আরও বেশি সন্দর লাগত।
সুকি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তয়াকে এভাবে ক্ষেপিয়ে দেবার ব্যাপারে সুকি কিওকোর সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল। ওর নিজস্ব একটা লক্ষণরেখা আছে যেটা কোনভাবেই অতিক্রম করা ঠিক হয়নি। আর এটাও ঠিক নয় যে, কিওকোর এ ব্যাপারে কোন ধারণাই থাকবে না যে, সে আসলে এক রক্ষককে অসম্মান করছে।
“আমি দেখেছি, আগুন নিয়ে খেললে অনেক সময় নিজের হাত পুড়ে যাবার ভয় থাকে,” চুপ করে থাকা গোটা টেবিলটার জন্য শিনবে বলে উঠল, আর সঙ্গে-সঙ্গেই পুরস্কার হিসেবে বাকি সকলে কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে তাকে উপেক্ষা করল।
তয়া আরেকবার কিওকোর দিকে আড়চোখে তাকাল। তাহলে, এই সেই মেয়ে যারা দিকে তার তাকাবার কথা? কিউ ভেবে আমোদিত হল। কিউ তাকে আজ সকালেই ওর আসার ব্যাপারে জানিয়েছিল, আর সেই সঙ্গে তাকে পর্যাপ্তভাবে সতর্ক করে দিয়েছিল সে যেন ওকে দেখে রাখে এবং ওর যেন কোন বিপদ না হয় তার দিকে খেয়াল রাখে।
সে এইবার তার চোখ এই যুবকের উপর কেন্দ্রীভূত করল যে একটু আগেই তাদের টেবিলে ছিল। সে যেভাবে কিওকোর দিকে তাকিয়েছিল তা তাকে কিছুটা ক্রুদ্ধ করেছিল। ঋত্বিকা কি সত্যিই কোন বিপদে ছিল? সাধারণ এক মানবকে নিরাপদে রাখার ব্যাপারে কিউ এতটা আগ্রহ কেন দেখাবে? কিউ কাউকেই কোনদিন যথাযোগ্য সম্মান দেখায়নি, তাই এই তুচ্ছ মেয়েটির ব্যাপারে সে হঠাৎ এরকম ভিন্ন আচরণ করছিল কেন?
তয়া এক এক সময় এই ভেবে বিরক্ত হত যে, কিউকে কেন তার রক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু তাকে এ কথা স্বীকার করে নিতেই হবে যে, সে যেভাবে তার খেয়াল রাখে তার জন্য সে কিউকের কাছে ভীষণভাবে ঋণী। সে এ-ও জানতে যে, কিউ যখনই কোন কিছু করে তার পিছনে যথেষ্ট কারণ থাকে এবং এই কিওকো নামক মেয়েটার ব্যাপারে তার আচরণ সেই জন্যই তাকে অবাক করেছিল।
টেবিলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া এই চাপা উত্তেজনা লক্ষ্য করতে গিয়ে শিনবে তার হাতটা প্রায় কেটেই ফেলেছিল, আর সঙ্গে-সঙ্গে সুকির দিকে দেখল যে তার দিকেই বড়-বড় চোখ করে তাকিয়েছিল। সে তার ভাব-ভঙ্গি দিয়ে কিওকোকে হাসাতে পারে তা জানত, আর তাই সে সেটাই করার চেষ্টা করল।
"সুকি, তাহলে এসবের পরও কি তুমি আজ রাতে আমার সাথেই ক্লাবে যেতে চাও? আজ তো শনিবার, আর শনিবারের রাতটা আমি নিঃসন্দেরে তোমার সঙ্গেই নাচতে চাই, কতগুলো অজানা-অচেনা মেয়েদের সাথে নেচে-গেয়ে আমার সময় কাটবে না।” এই বলে শিনবে তার চোখে এমন একটা ভাব নিয়ে এলো যেন এই মুহূর্তে সে অজানা-অচেনা কতগুলো মেয়েদের সঙ্গে নাচছে এবং তাতে তার কী অবস্থা হচ্ছে তার প্রমাণ দিচ্ছে।
সুকি তার দিকে এমনভাবে দেখল যেন এক চড়ে তার ঘোর ভেঙ্গে দিতে চাইল এবং তারপর সে কিওকোর দিকে মুখ ফেরাল। “কিওকো, আমার একজন খেয়াল রাখার লোক চাই,” বলে মুচকি হাসল। "তুমি তো রয়েইছো, তাই না? খুবই বিপজ্জনক হবে যদি আমি লোকটার সাথে একা যাই,” এই বলে সে কিওকোর দিকে অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকাল।
এই শুনে শিনবের ঘোর ভেঙ্গে গেল আর সে বড়-বড় চোখ করে তাকাল দেখে কিওকো বেশ মজা পেল আর তার ঠোঁটের দু’পাশে হাসির রেখা দেখা গেল। “সুকি, তোমাদের সাথে যেতে আমার দারুণ লাগবে। আর আমরা একসঙ্গে থাকলে শিনবেকেও সামলাতে পারব যদি সে বেসামাল হয়ে পড়ে কখনো।”
এইবার দু’জনেই শিনবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির শিকার হল এবং সে গজগজ করতে লাগল। এই সব দেখে কিওকো আর নিজেকে সামলাতে পারল না, হো-হো করে হেসে উঠল। এই দু’জনকে তার খুব ভাল লেগে গেছিল।
তয়া কিওকোকে আড়চোখে দেখেই যাচ্ছিল। ওহ্, এভাবে হাসলে ওকে দারুণ সুন্দর লাগে কিন্তু। তয়া মনে-মনেই বলে ফেলল। কোথা থেকে যে এল ধারণাটা ওর মনে? চিন্তার এই ধারাপাত সামাল দিতে-দিতে ও ধপ করে ওর চেয়ারটাতে বসে পড়ল। “ধুর ছাই!” আজ রাতে ওকে ক্লাবে যেতেই হবে, আর শুধু কিওকোকে দেখার জন্যই। শিনবে আর সুকির কথাবার্তায় হাসতে-হাসতেই কিওকো এবার পিছন ফিরল।
পিছন ফিরে যেই ও তয়ার দিকে তাকাল, তয়ার দম বন্ধ হয়ে এল, এবং তার রক্ত কয়েক ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়িয়ে প্রায় ফুটতে শুরু করে দিল। তয়া খেয়াল করল একটু আগে ও যখন তয়ার উপর রাগ দেখাচ্ছিল তখনকার থেকেও এখন ওর মধ্যে অনেক বেশি শক্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। বহু দিন পর তয়া এই প্রথমবার কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করছিল।
কিওকোর মুখে লেগে থাকা হাসি যখন ফুরিয়ে গেল, তখন সে পিছন ফিরে সুকির দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখো, আমি এখনও জানি না সোমবার আমি কোন ক্লাসে গিয়ে বসব বা তার জন্য আমাকে ঠিক কোথায় যেতে হবে। আমাকে কোথায় গিয়ে খোঁজ করতে হবে তোমরা কেউ কি সে ব্যাপারে আমাকে বলতে পারো?"
সুকি উত্তর দিতে শুরু করার আগেই তয়া ওর দিকে এক পলকে তাকিয়ে ওর কথার উত্তর দিতে শুরু করে দিল। “স্কলারশিপ পাওয়া সব ছাত্র-ছাত্রীকেই একই ক্লাসে পড়ানো হয়। তাই তুমি, সুকি, শিনবে এবং অন্য সকলেই একই ক্লাসেই থাকবে। আলাদা ক্লাসে তখনই যেতে হবে যখন অধিপতি তোমাদের ক্লাস নেবেন।” চেয়ারে হেলান দেওয়া অবস্থায় অলস কণ্ঠে সে কথাগুলি বলে গেল।
কিওকো ভ্রু কুঁচকে তাকাল, "অধিপতি আবার কোন ক্লাসে পড়ায়?"
এইবার শিনবে ওদের কথোপকথনের মধ্যে ঢুকে পড়ে উত্তরটা দিল, এবং উত্তর দেবার সময় ওর চোখে এক ধরনের রহস্যের ছবি দেখা গেল, “আমাদের সকলের জন্য তা আলাদা। আর সেই জন্যই তিনি আমাদের প্রত্যেকের আলাদা ক্লাস নেন। তিনি আমাদেরকে আমাদের মধ্যে থাকা বিশেষ দক্ষতাগুলিকে আরও বিকশিত করতে সাহায্য করেন।” সে কিছুটা ভাবুক ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে বসল এবং মুচকি হেসে বলল, “আমার মনে হয়, তোমার পুরুতগিরি ওখানে কিছুটা উন্নতি লাভ করতে পারবে।”
এই শুনে কিওকোর পারদ একেবারে সপ্তমে চড়ে গেল, এই ভেবে যে, অধিপতি এটা কীভাবে জানবেন যে, ও একজন ঋত্বিকা। স্কলারশিপে এ ব্যাপারে কোন কিছুই লেখা ছিল না। বিগত কয়েক বছর ধরে সে তার যে ক্ষমতাকে কবর দিতে চেষ্টা করে আসছে সেই ক্ষমতার জন্যই নাকি এই স্কুলের অধিপতি তাকে স্কলারশিপ দিয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এর কারণ জানার তীব্র ইচ্ছা ওর মধ্যে তৈরি হল।
নিজের খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে কিওকো কঠিন গলায় বলল, “কিছু একটা ভুল হচ্ছে হয়ত। আমি কি কোনভাবে এই মুহূর্তে স্কুলের অধিপতির সাথে কথা বলতে পারি?”
তয়া চোখ ছোট করে ওর দিকে তাকাল। কিউ তাকে বলেছিল কিওকো তার সঙ্গে দেখা করতে চাইতে পারে, আর সে যেহেতু ক্লাসের বাইরে কারো সঙ্গে দেখা করে না, তাই সে তয়াকে বলে রেখেছিল কিওকোর কোন প্রশ্ন থাকলে তয়া যেন তাকে তার কাছে নিয়ে আছে।
"কী হল, ভয় পেয়ে গেলে নাকি?" সে কিছুটা কৌতুকের সুরে জিজ্ঞাসা করল এবং সঙ্গে-সঙ্গেই কিওকোর ক্রুদ্ধ চোখের কটমট করা চাউনির পুরস্কারও পেয়ে গেল। যা হোক, কিওকো ভাবছিল সে অধিপতিকে কাবু করে নেবে। কিউয়ের উপরেও যদি তার এই ক্রুদ্ধ চোখের চাউনি কাজ করে যায় তাহলে তো ভালই। কিন্তু তয়া যেটা ভেবে ভয় পাচ্ছিল সেটা ও নিজের চোখে দেখেছিল যে, কীভাবে কিউ যে কোন ব্যক্তিকে মুখে একটি কথাও না বলে তার মধ্যে প্রবেশ করে তাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারত।
“ভাল কথা, তুমি প্রস্তুত হলেই আমি তোমাকে ওর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেব,” তয়া ওকে কিছুটা চ্যালেঞ্জের সুরেই কথাগুলো বলল এটা দেখার জন্য যে, ও সেটা নেয় কিনা।
এই কথা শুনে কিওকোর রাগ কিছুটা প্রশমিত হল। সে তার খাবার প্লেটটাকে ঠেলে সরিয়ে দিল, মাথা নেড়ে তয়ার ধাপ্পাবাজির যোগ্য জবাব দেবার জন্য বলে উঠল, “তুমি প্রস্তুত হলেই আমিও প্রস্তুত।” সে তার একটা দিকের চোখের ভ্রু তুলে ওর চ্যালেঞ্জের জবাব দিল।
"এত তাড়া কীসের?" তয়া একটু হেসে উঠে দাঁড়াল। “আমি চাই তুমি তোমার রাগের হাঁড়িতে একটু ঢাকনা চাপা দাও কারণ ও সেটা ধরে ফেলতে পারে,” একটু হেসে তয়া ওকে কথাগুলো বলল, এই ভেবে নিয়ে যে ও ঠিক কী করতে চলেছে সে ব্যাপারে ওর কোন ধারণাই নেই।
কিওকো চোখ ছোট করে তয়ার দিকে তাকাল এবং উঠে দাঁড়াল, তারপর সুকি আর শিনবের দিকে পিছন ফিরে তাকাল। “আমার হয়ে গেলে আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলব, তোমরা যদি আমাকে এসে নিয়ে যেতে পার। আমি আমার ঘরেই অপেক্ষা করে থাকব আর আমরা আজ সন্ধ্যায় যাবার কথা ভাবতে পারি।” সে সুকিকে ইশারা করল এবং তারপর তয়ার দিকে ফিরে তাকাল এবং ভাবলেশহীন কণ্ঠে তাকে বলল। “মানে, আমি যদি থাকার সিদ্ধান্ত নিই, তাহলে।”
তয়া মুচকি হেসে কিওকোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল এবং কিওকো দেখল সে ধীরে ধীরে তার থেকে দূরে চলে যেতে যেতে অন্যদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে কিছু ইশারা করল। কিওকো লক্ষ্য করল ওই ইশারা পাওয়া মাত্রই ঘরে উপস্থিত অন্য সব ছাত্র-ছাত্রীরা দ্রুত তার পিছনে-পিছনে ঘর ছাড়ল। “ও কে? স্কুলের দাদা নাকি?”
কিওকো তাকে নিজেকে তার পিছনে-পিছনে ছুটতে দেখার সুখ দিতে চাইল না, তাই সে নিজের সময় নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে ঘর থেকে বেরোল এবং ইচ্ছে করেই ওর অনেকটা পিছনে নিজেকে রাখল। কিন্তু ওর উপর রেগে থাকা সত্ত্বেও কিওকোর চোখ যখন তয়ার পিছন দিকটাতে পড়ল ও কিছুটা লজ্জারুণ হয়ে উঠল। কিওকো দেখল ওর লম্বা-লম্বা চুলগুলো তয়ার নিতম্বকে ঢেকে দিয়েছিল, যা তার নিচে থাকা শক্তপোক্ত গড়নকে যেন আরও প্রকট করে তুলছিল যেটা তাকে আরও বিব্রত করে তুলল। রেগে আগুন হওয়া ও সৌন্দর্য খুব ভয়ংকর একটা সমন্বয়।
নিজের চোখের অসংযমী নজরকে দুষতে-দুষতে মাথাটাকে নাড়িয়ে নিয়ে সে তয়ার পিছন-পিছন এগিয়ে যেতে লাগল। “যাকে তুমি সহ্যই করতে পারছ না তার মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজে পেতে গেলে মাথা মোটা না হলে চলে না,” কিওকো নিজে-নিজেই বিড়বিড় করে বলল। “বিরক্তিকর... শত্রুর বাড়া... উদ্ধত... এ সবই হতে পারে, সুন্দর কখনই নয়,” এই ভেবে সে একটু মুচকি হাসল। এইবার কিছুটা হালকা লাগছিল।
হঠাৎ করেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি তার শিড়দাঁড়া সংকেত দিল এবং সে তার চোখের দৃষ্টি উপরে তুলল এবং তার চোখকে বিদ্ধ করতে থাকা একজোড়া চোখের উপর গিয়ে আটকে গেল। সিঁড়ি একেবারে উপরের ধাপে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার গাঢ় কালো-বাদামী রংয়ের চুলগুলো তার কাঁধের দু’পাশ দিয়ে পিছনে ঢলে পড়ছিল এবং তার চোখ দুটো মধ্যরাতের গাঢ় অন্ধকারের মতো গভীর ছিল। ছেলেটি খুবই আকর্ষক ছিল, কিন্তু কেন যেন কিওকোর অনুভূতিটা ছিল... ভীত।
সে তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। 'কিওকো, নিজেকে একটু সামলাও। যাকেই দেখছ, তার সম্বন্ধেই কিছু না কিছু আগে থেকেই ভেবে নেওয়া বন্ধ কর,' সে নিজেই নিজেকে কথাগুলো বলল এবং এমনকি আবার তার পান্না-সম চোখ দুটিকে সেই ছেলেটির চোখে ফিরিয়ে নেয়ে গেল।
“আমাদের ক্যাম্পাসের এই সেই মেয়ে যে একজন ঋত্বিকা।”
কিওকো তার দুই কাঁধ জুড়ে একটা শক্ত-পোক্ত হাত চালিত হবার অনুভূতি পেল এবং সকালে যে ছেলেটি তাকে তার ঘর অবধি পৌঁছে দিয়ে এসেছিল তার কণ্ঠস্বর মনে করে সে পিছন ফিরে তাকাল। সে তার দুই গালে তার চুলের শুড়শুড়ি অনুভব করল যেহেতু হঠাৎ করেই কোথা থেকে হাওয়া এসে তার গাল ঘেষে চলে যাচ্ছিল।
কিওকো ওর দিকে আন্তরিকতার সঙ্গে তাকাল এবং হাসল, কিন্তু একই সঙ্গে একটু নিচু হয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে তার বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্তও করল। “তোমার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে ভাল লাগছে, কোতারো। আজ সকালে আমাকে যেভাবে সাহায্য করেছিলে তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ,” কিওকো কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে কথাগুলো বলল, এই ভেবে যে, কোতারো হয়ত তার সঙ্গে ততটা পরিচিতের মতো আচরণ করবে না। সে ভাবল কোতারো বেশ ভাল ছেলে এবং সেইটুকুই, কিন্তু তার মানে এটা নয় যে, সে তার দুই কাঁধে হাত রেখে কথা বলতে পারে।
কোতারো এ সবে কোনভাবেই প্রভাবিত না হয়ে দ্রুত কিওকোর একটা হাত তার মধ্যে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করল, "তোমাকে কি আর কোথাও পৌঁছে দিতে পারি, কিওকো?" সে কিওকোর পান্না-সম চোখে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, এটা জেনেই যে সে আগেও এই চোখ দুটিকে দেখে... কোন এক জায়গায়। আর তার মনের মধ্যে আবছা একটা অনুভূতি এইরকম হচ্ছিল যে, সে হয়ত এই দুই চোখে ডুবও দিয়েছিল কখনও।
কিওকো সিঁড়ির উপর তাকিয়ে দেখল তয়া থেমে গেল এবং ঘুরে তাকাল, তাকে আবার ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছে। সে হলফ করে বলতে পারে সে তয়াকে গজগজ করতে শুনেছিল, তার উপরেই হোক বা কোতারোর উপরে, কার উপর সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত হতে পারল না।
কোতারোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে তয়ার কোন ধারণা ছিল না, কিন্তু সে যে কিওকোর সঙ্গে অতটা ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল সেটা ওর পছন্দ হচ্ছিল না। ভিতর থেকে উঠে আসা একটা গর্জন-সহ তয়া সতর্ক করে দিল, “আমি সেটা দেখে নেব, কোতারো, যদি না তুমি ওকে কিউয়ের সাথে দেখা করাতে নিয়ে যেতে চাও।” সে কটমট করে কোতারের দিকে তাকাল, এটা জেনেই যে, কোতারো ক্লাস ছাড়া বা ডেকে না পাঠানো ছাড়া কিউয়ের ধারে-কাছে ঘেঁষতে চাইবে না।
কোতারো কিওকোর হাতটা ছেড়ে দিল, “আশা করি সব ঠিকঠাকই আছে, কিওকো।” এই বলে সে তয়ার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আবার কিওকোর দিকে ফিরল, “এখানকার বাসি খাবার-দাবার সম্পর্কে খেয়াল রেখে চলবে। ও যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে তাহলে তোমার হয়ে আমি ওর ব্যবস্থা করে দেব।” কোতারো তয়ার দিকে কিছুটা দাম্ভিক দৃষ্টিতে তাকাল আর তারপর কিওকোর দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে পিছন ফিরল এবং সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে থাকল।
কিওকো তয়াকে ফোঁসফোঁস করতে শুনতে পেল এবং ওর দিকে তাকাল এবং দেখল ও বারান্দা ধরে হাঁটতে শুরু করেছে, সেই রাস্তাতেই যে রাস্তা দিয়ে আজ সকালে কিওকো তার ঘরের দিকে গেছিল।
এইবার কিওকো দ্রুত পায়ে হেঁটে তয়াকে ধরে ফেলল যখন সে সেই ঘরটার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল যেটার দরজায় লেখা ছিল প্রবেশ নিষেধ । কিওকোর জানতে ইচ্ছে করছিল তারা ঠিক কোথায় যাচ্ছে। তয়ার পিছনে-পিছনে হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ করে তার মনে হল তয়া তো ওকে ওর ঘরের দিকেই নিয়ে চলেছে। সে সত্যি-সত্যিই কিওকোর ঘরেরে সামনে এসে থেমে গেল, এবং ওর দিকে তাকাল, আর কিওকোও ওর দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল যতক্ষণ না সে তার ঘরের অপর প্রান্তে থাকা দরজাটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সেটার সামনে গিয়ে তাতে টোকা দিল।
কিওকো থতমত খেয়ে গেল। অধিপতি তার ঘরের মধ্যে থাকা দরজার অপর প্রান্তে থাকে? কিওকোর আরও একবার তার ভাইয়ের কথাটা মনের মধ্যে এসে খোঁচা দিল। ‘হতেই পারে না!’ ওপাশ থেকে কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই তয়া দরজাটা ঠেলে খুলে নিয়ে কিওকোকে ঠেলে নিজের সামনে রেখে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
কিওকো সঙ্গে-সঙ্গে পিছন ফিরল। “তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না, কিন্তু দয়া করে আমাকে ঠেলো না,” সে তয়াকে ঠেলে সরিয়ে দিল, “বা আমার গায়ে হাতও দিও না। আমি তো তোমাকে কিছুই করিনি।” এই বলতে-বলতে সে খেয়াল করল তয়া তার পিছনে কোন কিছুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
কিওকোর কাঁধে একটা হাওয়ার ঝাপটা লাগল। কিওকো সেই কাজটাই করে ফেলল। ওকে কি সবসময়েই কারো উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই হবে এটা না ভেবেই যে, সে কোথায় রয়েছে এবং কে তাকে দেখছে?
কিওকোকে এভাবে উত্তেজিত হতে দেখে তয়া মুচকি হাসল, চোখ নামিয়ে তার চোখের দিকে তাকাল যেটা এই মুহূর্তে ছোট্ট হয়ে গেছিল। "তুমি কার সঙ্গে কথা বলতে চাও বলেছিলে না?" কিওকো যখন পিছন দিকে ফিরল না, তয়া তার চোখটা ছোট করে পিছনে কিউয়ের দিকে তাকাল, যে সেই সময় বসার ঘরের দরজার হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কিওকোর দিকে তাকিয়েছিল যাকে এই মুহূর্তে নিথর একটা দেহ মনে হচ্ছিল।
'কী হচ্ছেটা কী?’ তয়া মনে-মনে ভাবল। কিওকো এভাবে তার দিকে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে রয়েছে কেন? কিছুটা অবধি, এর জন্য তার মধ্যে যে ঈর্ষার অনুভূতি তৈরি হয়েছিল সেটাকে সে চিহ্নিত করতে চাইছিল না। এই মুহূর্তে তার মনের মধ্যে এমন একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল যেটা তাকে বলছিল সে যেন এক্ষুণি সামনে এগিয়ে যায় এবং কিওকো ও কিউয়ের মাঝে দাড়িয়ে কিউয়ের দৃষ্টি থেকে কিওকোকে আড়াল করে। সে ওকে রক্ষা করতে চাইছিল।
কিউও কিছুক্ষণের জন্য হলেও তার বাকশক্তি হারিয়েছিল, হাজার বছরের ব্যবধানে প্রথমবারের জন্য কিওকোকে এভাবে তার এতটা কাছে দেখে। কিওকোর চারিপাশে ঘুরতে থাকা দমকা বাতাস তাকে স্মৃতি হাঁতড়াতে প্ররোচিত করল... সেই একই অকাট্য প্ররোচনা যা অতীতেও তাকে ওর কাছে নিয়ে এসেছিল, যা আজও হারিয়ে যায়নি।
ওর সোনালি চোখের উদাসীন দৃষ্টি কিওকোর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষকের উপর পড়ল। “তুমি যেতে পারো, তয়া।” একটা বিপজ্জনক হুমকিপূর্ণ ভারী আওয়াজ বেরিয়ে এলো ওর গলা থেকে।
তয়া গলাতেও এক ধরনের গর্জন তৈরি হচ্ছিল এবং এবং তার হাতের তালু দুটো ক্রুদ্ধ মুঠোয় পরিণত হচ্ছিল কারণ স্মৃতির গভীর গহ্বর থেকে এক ধরনের অজানা ভয়ের অনুভূতি মাথা চাড়া দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল মনের ভিতর থেকে। আর একটিও কথা না বলে তয়া ঘুরে দাঁড়াল এবং দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেল।
তয়ার চলে যাওয়াটা কিওকো দেখল কিন্তু একই সাথে তার মনের ভিতরটা তখন একগুচ্ছ স্মৃতি আর চিন্তায় তোলপাড় হচ্ছিল। হঠাৎ করেই তার মধ্যে তয়ার পিছনে-পিছনে দৌড়ে বেরিয়ে যাবার একটা তীব্র ইচ্ছার ঢেউ খেলে গেল। কিন্তু শেষ অবধি নিজেকে এভাবে ভীতু প্রতিপন্ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সে আস্তে করে তার চিবুক ওপরে তুলল এবং মুহূর্তের মধ্যে মনোবল ফিরে পেল, এবং শেষ অবধি পিছন ঘুরে যখন চোখ রাখল সে যা দেখল তাকে বিশ্বাস করতে তার ইচ্ছা হল না।
লম্বা বিজনে-সস্যুট পরিহিত একজন বয়স্ক লোককে দেখার বদলে সে তার মুখো-মুখি যাকে দেখল... তার সোনালি চোখ কিওকোর চোখ দুটিকে গলিয়ে দিয়েছিল এবং তার সেই চোখ দুটো থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নেবার অনেক চেষ্টা করেও সে পেরে উঠল না। তার রূপালী চুলের ঢেউ তার দুই কাঁধের উপর নেমেছিল, আর তার দেহটা দেখে মনে হচ্ছিল তা যেন কোন দক্ষ ভাস্করের ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে তৈরি। সে ছিল খুব লম্বা ও খুব সুপুরুষ একজন যুবক, সেই সঙ্গে তার গোটা শরীর জুড়ে একটা রাজকীয় ঔদ্ধত্য বিরাজ করছিল, আর মুখটা যেন ছিল ঈশ্বরের উপহার।
কিওকো তাৎক্ষণিকভাবে তার চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। এ কী হল তার? ও তো এখানে প্রশ্ন করতে এসেছিল, রূপের বশে বশীভূত হতে নয়। কিওকো যখন তার চোখ খুলল, পুরুষটি তখন তার অনেক কাছে চলে এসেছিল। সে সঙ্গে-সঙ্গে সেই রাজকীয় ও উদ্ধত চেহারা-ছবি থেকে এক কদম পিছনে চলে গেল এবং পিঠে দরজার স্পর্শ পেল... যা তাকে আটকে রাখছিল।
সে কী করেছে তা উপলব্ধি না করেই কিউ তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু যেই মাত্র সে বুঝতে পারল কিওকো পিছিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে-সঙ্গে সে তার মার্জিতভাবে তার চোখের ভ্রু দুটি তুলল এবং একটা হাত পাশে থাকা সোফার দিকে নির্দেশ করল। "আপনি কি একটু বসতে চাইবেন, মিস হোগো?" সে জানত কিওকোর মনে তার উদ্দেশ্য নানান প্রশ্ন আছে। যদি না থাকত তাহলেই বরং সে কিছুটা হতাশ হত।
কিওকো কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে ঢোক গিলল কিন্তু তারপরেই উদ্ধত ভঙ্গিতে তার চিবুক তুলল, সোফার দিকে এগিয়ে গেল, কিউয়ের থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব রেখে বসে পড়ল, আর কিছু না হোক তাতে অন্তত তার মস্তিস্ক ঠিকঠাকভাবে কাজ করতে পারবে এই আশায়। কিওকো ভিতরে-ভিতরে একটু হাসল।
"প্রথমেই যেটা আমি জানতে চাইব তা হল, আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি একজন ঋত্বিকা?" সে সতর্ক দৃষ্টিতে কিউয়ের দিকে তাকাল এবং প্রায় অদ্ভুত একটা আচরণ করল যখন সে দেখল কিউ অন্য দিকে রাখা চেয়ারটায় গিয়ে না বসে সোফায় তার পাশে বসে পড়ল। কিওকো তার শরীরটা একটু সরিয়ে তার দিকে তাকাল, যাতে তাকে আরও সরে না যেতে হয় এবং তাতে তার ভয় প্রকাশিত না হয়ে পড়ে।
'বেশ, তুমি তাহলে খেলতে চাও,' কিউ মনে-মনে এটা ভেবে বেশ আমোদিত হল, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই মনের গোপন ভাব ঝেড়েও ফেলল। "আপনার কী থেকে মনে হল যে আপনি যে একজন ঋত্বিকা তা আমার অজানা থাকবে?" স্বভাবসিদ্ধ শান্ত ভাষায় সে পাল্টা প্রশ্ন করল। সে যখন কিওকোর পানের পাতার মতো আকৃতির মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ে তাকে জিজ্ঞাসা করছিল তখন তার তুলনায় কিওকোর চেহেরাটা খুবই ছোট লাগছিল।
কিওকো তার মুখের সমস্ত বলিরেখাগুলিকে নজর করছিল তার মধ্যে কোনরকম আবেগের ইঙ্গিত ধরা পড়ে কিনা তা দেখার জন্য এবং সেই রকমই একটা ইঙ্গিত পেয়ে কিছুটা অবাক হল। সে যেন কোন ভাস্করের নিখুঁত ও শান্ত হাতে তৈরি কোন মানুষ, আর সেটাই কিওকোকে বেশ বিব্রত করছিল।
"আপনি কি সবসময়েই প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করে থাকেন নাকি, মিস্টার…?” সে কিছুটা তোতলার মতো কথাগুলো বলে ফেলল এমনকি তার নাম পর্যন্ত না জানতে চেয়ে।
কিউ হাসল, কিন্তু মনে-মনে, তাই কিওকোর চোখে তা ধরা পড়ল না। তবে সে বলতেই পারত কিওকোর মধ্যে এখনও প্রাণবন্ততা রয়েছে এবং তাতে সে এতটুকু হতাশ হয়নি। বরং সে তার মধ্যে আরও প্রাণোচ্ছলতা দেখতে চাইছিল। "মিস্টার লর্ড, কিন্তু আপনি আমাকে কিউ বলেই ডাকতে পারেন, যদি না লর্ড নামটাই আপনার বেশি পছন্দ হয়।" এরপর ও খুব উষ্ণ দৃষ্টিতে কিওকোর মুখের উপর তাকিয়ে ওকে একেবারে কাবু করে দিল।
কিওকোর উপর তার প্রভাব ভালই পড়ল, "কেন… আমি… কি… এখানে?" সে প্রত্যেকটা শব্দ আস্তে-আস্তে এবং আলাদা-আলাদা করে বলেছিল, যেন সে কোন বাচ্চার সাথে কথা বলছে। কিউ তার এর থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসে সেটাই দেখার। ‘মিস্টার লর্ড না ছাই।’ কিওকো নিজের মধ্যেই তাচ্ছিল্যের সুর ভরে নিল, তার চোখ থেকে চোখ না সরিয়েই।
কিওকোর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে কিউয়ের সোনালি চোখ দুটি জ্বলে উঠল এবং ছোট হয়ে কিওকোর পান্না রংয়ের চোখের উপর কেন্দ্রীভূত হল। সে কিওকোর দিকে একটু ঝুঁকল, এটা বুঝতে পেরেই যে এতে কিওকো একটু ঘাবড়ে যাবে। সে ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল।
“আপনার পৌরোহিত্যের শক্তি দুর্বল এবং অপ্রশিক্ষিত, না হলে আপনি বুঝতে পারতেন আমি কীভাবে বুঝলাম আপনি একজন ঋত্বিকা,” সে কিছুটা হিসহিস শব্দে কথাগুলো কিওকোকে বলল, শুধু একবারে জন্য তার শান্তভাব হারিয়ে যার পরেই আবার তা তার চোখে-মুখে ফিরে এসেছিল। “আমি আপনাকে মার্শাল আর্ট শেখাব, আপনার শক্তি বৃদ্ধির শিক্ষা-সহ... যেটার অভাব আপনার মধ্যে রয়েছে।”
কিওকোর কাছে তার এই কথাগুলোর মধ্যে শেষেরটা কিছুটা অপমানের মতো লাগল। কিছুটা মাথা-গরম স্বভাবের বলে পরিচিত কিওকো এবার কিউয়ের দিকে ঝুঁকে প্রায় তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেল এবং তার ভঙ্গিমায় বিদ্রূপ ভরে নিল। “এমনও হতে পারে যে, আমি আমার প্রকৃত শক্তি লুকিয়ে রেখেছি, আর আমার সমকক্ষ কিছু সামনে এলেই আমি তা দেখিয়ে দেব।” তার রাগ, বা তার নির্বুদ্ধিতা, এক মুহূর্তের জন্য তাকে ভয়শূন্য করে তুলেছিল, ঠিক কোনটা সে ব্যাপারে সে ততটা নিশ্চিত ছিল না।
কিউ আরও একটু কাছে ঝুঁকল, তার ঠোঁট দুটো প্রায় কিওকোর ঠোটের কাছে নিয়ে গেল যাতে তার গরম নিঃশ্বাস কিওকো অনুভব করতে পারে। তারপর সে ঠাণ্ডা গলায় ফিসফিস করে বলল, “ঋত্বিকা।”
অধ্যায় ৪ “মনোযোগ দাও”
কিওকো ছিটকে সরে গিয়ে নিজেকে ওর থেকে দূরে নিয়ে গেল, আর হঠাৎ করেই সে কিউয়ের মধ্যে থেকে এমন আবহ পাচ্ছিল যা তার পাওয়ার কথা ছিল না। এখানে কিছু একটা হচ্ছে এবং কিওকোর মনে হচ্ছিল সে ছাড়া বাকি সবাই বোধহয় সে ব্যাপারে জানে।
“আমি এখনও আমার উত্তর পাইনি,” কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে সে ফিসফিস করে বলল, সেই সঙ্গে কিউয়ের তৈরি এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ থেকে নিজেকে মুক্ত করার আশায় নিজের নিচের ঠোঁটে নিজেই কামড় বসাচ্ছিল। সে চাইছিল এই দমবন্ধ করা রোমাঞ্চর কম্পন থেকে সে যেন দ্রুত ছাড়া পায় যা তার স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে যেন একটা বুলেট ট্রেন ছুটিয়ে বেড়াচ্ছিল।
কিওকোর শরীরের গন্ধ তার নাকে পৌঁছালে এবং তাতে তার রক্ত ফুটতে শুরু করলে কিউ নিজেকে তার থেকে সরিয়ে আনার জন্য নিজের শরীর সোজা করে নিল। সে ছোট-খাটো চেহারার মেয়েটিকে কাঁপতে দেখেছিল, কিন্তু তাতে বিদ্রোহ ছিল না। নিজের চোখ দুটিকে নিচে নামিয়ে সে মুচকি হাসল, আর তখনই সে বুঝল তার দুই বাহুর রোম খাঁড়া হয়ে গেছে।
“আপনি কেন আপনার শক্তি লুকোচ্ছেন? আপনাকে আপনার পারিপার্শ্বিক দুনিয়া সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে অতীতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবার আগেই।” কিছুটা উদ্ধত কণ্ঠেই কিউ কথাগুলো কিওকোর উদ্দেশ্যে বলল।
কিওকো ঢোক গিলে বলল, "কী বলতে চাইছেন আপনি?" ও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল।
"আপনি তো জানেনই যে এই স্কুলে চিরঞ্জীবীরা রয়েছেন, ঠিক বলছি তো?" কিউয়ের চোখে এমন এক দ্যুতি ছিল যা কিওকো আগে কখনও দেখেনি, আর তার কণ্ঠস্বর ছিল কর্কশ যেন সে তাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। “এই যে আমরা কথা বলছি এর মধ্যেই দৈত্যেরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।”
কিওকোর চোখ দুটো একটু প্রসারিত হয়ে আবার ছোট হয়ে গেল। কিউ কি তার সঙ্গে কোন খেলা খেলছে? "আপনার কেন মনে হচ্ছে এখানে রক্ষক ও দৈত্যেরা রয়েছে?" সে কিছুটা অননুমোদনের সুরে কথাটা জিজ্ঞাসা করল।
হঠাৎ করেই কিউ এক হেঁচকা টানে কিওকোর হাতটা ধরে তাকে তুলে নিল, মুখটা ওর মুখের খুব কাছে নিয়ে চলে এল। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “মনোযোগ দাও।”
কিওকো চোখের পলক ফেলল, সে যা দেখছিল তা তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। এইভাবে কিউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে তার মনে হচ্ছিল সে সেই মানুষটা নয় যার সঙ্গে একটু আগেই সে কথা বলছিল। সেই লোকটার চোখে অস্বাভাবিক চমক, বিরক্তি, সোনালি দ্যুতি তৈরি হয়েছিল, যার নিচে সে ছোট-ছোট বিষদাঁত দেখতে পাচ্ছিল, আর তার হাতে একটা পাঞ্জা বিদ্ধ হওয়ার অনুভূতি হচ্ছিল।
লোকটার চুলের দৈর্ঘ্য কিছুক্ষণ আগেই যা ছিল তার থেকে দ্বিগুণ হয়ে গেছিল এবং তার মুখের দু’পাশে এমনভাবে ভাসছিল যেন তার অনুমতির অপেক্ষা করছে। হতচিকত হয়ে তীব্র এক চিৎকার করে কিওকো নিজেকে ওর হাত থেকে মুক্ত করল এবং দ্রুত দু’ কদম পিছিয়ে গেল, আর দেখল কিউ তাকে আরও ভীত করে তার দিকে এগিয়ে এল।
"আপনি একজন রক্ষক?" সে হোঁচটা খাওয়া কণ্ঠে জানতে চাইল।
“আর তুমি সেই ঋত্বিকা যার আগে থেকেই সে ব্যাপারে জানার কথা,” সে হিসহিস শব্দে তাকে কথাগুলো বলল যেহেতু সে বুঝতে পারছিল তার রাগ আস্তে-আস্তে চলে যাচ্ছে।
কিওকো দ্রুত ঘুরে দরজার দিকে ছুটতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে যখন বুঝতে পারল যে, লোকটা তাকে পিছন থেকে তার দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে তখন সে চিৎকার করে উঠল।
সে যত তার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চেষ্টা করছিল কিউয়ের হাত দুটো ততই তাকে আরও শক্ত বন্ধনে বেঁধে ফেলছিল। সে তাকে জাপটে ধরে মেঝে থেকে তুলে নিয়েছিল, আর কিওকোর পা দুটো শূন্যে ছটফট করছিল তার থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টায়। ওর হাত থেকে ছাড়া পাবার চেষ্টা যে বৃথা তা উপলব্ধি করার পর্যাপ্ত সময় কিওকোকে দেবার পর, কিউ তার মুখটা কিওকোর কানের একেবারে কাছে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “শোন ঋত্বিকা, এখানে তুমি ততদিন অবধি থাকবে যতদিন না তুমি এই দুই বাহু থেকে নিজেকে মুক্ত করার মতো শক্তি অর্জন করছো।”
তারপর সে তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ওই সোফাটার উপর এমনভাবে বসিয়ে দিল যে কিওকো কিছুটা বলের মতো বাউন্স করল। এইবার তার হাত থেকে মুক্ত হয়েই কিওকো তীব্র একটা চিৎকার করল এবং তারপর চোখের পলক ফেলতেই সে আবার সেই লোকটাকেই তার সামনে দেখতে পেল যার সঙ্গে সে কিছুক্ষণ আগে কথা বলছিল।
লোকটার চোখে-চোখ রেখে, হাতের মুঠো পাকিয়ে নিয়ে, কিওকো বলল, "কী হচ্ছে এসব?"
কিউ শান্তভাবে তার সামনে দাঁড়িয়ে রইল, আর এইবার যে তফাৎটুকু ছিল ওর ভঙ্গিমায় তা হল, ওর চোখ দুটো তখনও জ্বল-জ্বল করছিল, “তুমি এখানে থাকবে।” সে কিওকোর দিকে ঝুঁকে বলল, “তুমি আমাকে তোমাকে প্রশিক্ষণ দেবার সুযোগ দেবে।” সে সোফার পিছন দিকে তার দু’হাত এমনভাবে রাখল যাতে তা কিওকোকে ঘিরে ফেলে এবং তারপর বলল, “আর এইবার, তুমি বলিদান ছাড়াই জিতবে।” কথাগুলি বলার সময় তার নাক প্রায় কিওকোর নাকের সঙ্গে ঠেকে গেছিল।
কিওকো যতটা সম্ভব সোফায় হেলান দিয়ে নিজেকে ওর থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করল, চোখ দুটোতে ততটাই হিংস্রতা রেখে, কিন্তু কোনভাবেই কিউয়ের থেকে কোন ভয়ের উদ্রেক তার মধ্যে হচ্ছিল না। সে মানুষ না হলেও কিওকোকে ক্ষতি করার কোন অভিপ্রায় ওর মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল না। এই মাত্র সে যেটা বলল সেটা শুনে কিওকো ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকাল।
"এই বার?" কিওকোর সুর নরম হয়েছিল, "এই বার... কী বলতে চাইছেন আপনি?"
কিউ গভীর দীর্ঘশ্বাস নিল, “তুমি হয়ত ভুলে গেছো, কিন্তু আমি যাইনি।” কিওকোর শরীরের গন্ধ তার চারিপাশে বিরাজ করছিল এবং তার বিস্মৃত হৃদয়ে সে এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করছিল, কিন্তু কিওকো তো সত্যিটা জানতেই হবে, “আমরা অতীতে এক সাথে লড়াই করেছিলাম, ঋত্বিকা, আর সেই সময় এগিয়ে আসছে যখন আমাদের আবার তা করতে হবে।”
মুহূর্তের মধ্যে কিওকোর চোখের দৃষ্টি নরম হয়ে গেল, "কে আপনি?"
“তোমার রক্ষক। কিওকো, আমি জানি তুমি ভুলে গেছো, কারণ রক্ষকের অন্তর-স্ফটিককে এই বিশ্বে ফিরিয়ে আনার জন্য তুমি আমাদের ব্যাপারে তোমার স্মৃতি বিসর্জন দিয়েছো।” তার চোখের মধ্যে কিওকোর প্রতি একটা অন্বেষণ ছিল এবং সে ফিসফিস করে বলল, “তোমাকে আমার উপর বিশ্বাস রাখতেই হবে।”
কিওকোর ভিতরকার সমস্ত অনুভূতি তাকে ওই লোকটাকে বিশ্বাস করার কথা বলছিল, এমনকি একটু আগে সে তাকে চূড়ান্ত ভয় পাইয়ে দেওয়া সত্ত্বেও। “অবশ্যই... আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।” কথাটা বলা মাত্রই সে তার হাতে একটা টান অনুভব করল। প্রথমে সে তার হাতটা একটু শক্ত করে নিয়েছিল কিন্তু তার চারিপাশে যে উষ্ণতা তৈরি হয়েছিল তাতে সে নিজেকে সমর্পণ করল এবং কিছুটা দ্বিধা নিয়ে হলেও তার আলিঙ্গনে সাড়া দিল।
এবার কিউ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। অনেকটা সময় ধরে সে সব কিছুতেই প্রত্যাখ্যাত হয়ে আসছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই তার টানে কিওকোর এভাবে সাড়া দেওয়ায় সেও কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। সে তাকে বুকের মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরল এবং কিওকোর সুবাসিত মুখের উপর তার মুখটা নামিয়ে আনল।
“এবারটা থেকে যাও,” সে ফিসফিস করে কিওকোকে বলল।
কিওকোর তার কথাবার্তায় এবং তার বাহুবন্ধে একটা আবেশ অনুভব করছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও কয়েক মুহূর্তে আগেও সে এই মানুষটাকে কেমন ভয় পাচ্ছিল, আর এখন সে এমনভাবে তাকে ধরে ছিল যেন তার উপর কিওকোর সারা জীবনের জন্য ভরসা করতে পারে। কিওকো সেই মুহূর্তে তার প্রতি ভয় ও তাকে জড়িয়ে ধরে তার গালে চুম্বন করার মাঝামাঝি একটা মানসিক স্থিতিতে অবস্থান করছিল।
তার মনে প্রচুর প্রশ্ন ছিল এবং সে তার বুকে মাথা রেখে বিড়বিড় করে বলছিল, “আমি যা যা ভুলে গেছি বলে তুমি বলছ, আমি সেই সব কিছু মনে করতে চাই। আমার কী কী জানা দরকার?"
কিউ তার সোনালি চোখ বন্ধ করল কারণ বাস্তব জগতে ফেরার ইচ্ছা এই মুহূর্তে তার হচ্ছিল না... কিওকো ঠিক সেখানেই ছিল যেখানে ওর থাকার কথা... ওর বাহু-বন্ধনে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিউ তাকে নিজের বাহু-বন্ধন থেকে মুক্ত করল এবং সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজে ওর পাশে বসে পড়ল।
নিজের অতি লম্বা-লম্বা চুলের মধ্যে দিয়ে হাত চালিয়ে সে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিজের মধ্যে তৈরি হওয়া তীব্র উত্তেজনাকে বশে আনার চেষ্টা করল। নিজেকে শান্ত করে নিয়ে সে তাদের সামনে থাকা দেওয়ালটার দিকে তাকাল এবং কিওকো যা জানতে চাইছিল তা তাকে বলতে শুরু করল। কোন কিছু মনে করা আর তা শোনা এক জিনিস নয়।
“তুমি সাহায্য পাবে। এখানে ঠিক তোমার মতো করে, স্কলারশিপ পেয়ে, যে সব ছাত্র-ছাত্রীরা এসেছে তাদের আমিই জড়ো করেছি। তোমাকে ওদের মনে নেই, তোমারও ওদেরকে না, কিন্তু সেই সময় ওরা তোমার সঙ্গে সেই লড়াইতে সামিল ছিল, এবং সময় এলেই ওরা আবারও তোমার সঙ্গে লড়বে,” তার কণ্ঠে অতীতের কোন ঘটনার স্মৃতির দরজায় কড়াঘাতের মতো শ্বাসাঘাত ছিল।
কিওকোর চোখ প্রসারিত হল, "সুকি আর শিনবে?" ওকে এতো সহজে কেন বিশ্বাস করছে সে ব্যাপারে কিছুটা বিস্মিত হয়েও সে জিজ্ঞাসা করল।
কিউ মাথা নাড়ল, “আমি দেখলাম তুমি ওদের সঙ্গে মিলিত হয়েছো। হ্যাঁ, তুমি ওদের খুবই কাছের মানুষ ছিলে, আর সঙ্গে তয়ারও যে তোমাকে সবচেয়ে বেশি আগলে রাখত।”
"তয়া?" কিওকো চোখের ভ্রু তুলে ওকে জিজ্ঞাসা করল। “তুমি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছো।” আর সে মনে মনে বলল, ‘ও তো আমাকে পছন্দও করে না।'
কিউ অসম্মতিসূচক দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “এই জীবনে তয়ার কোন পরিবর্তন হয়নি, আর সে এখনও তার অতীত জীবনের মতোই উদ্ধত, মাথা-গরম একটা যুবকই রয়ে গেছে। কিন্তু হ্যাঁ, সে একটা প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে তোমাকে রক্ষা করত, এবং তেমন প্রয়োজন হলে সে তোমার জন্য নিজের জীবনও দিয়ে দিত।”
কিউকো ভ্রু কুঁচকে তাকাল, "ওর মনে নেই?" কিওকোর মনে হচ্ছিল কিউ তাকে সত্যি কথাগুলোই বলছে এবং সেগুলো যেহেতু তার ভাসা-ভাসা স্মৃতির টুকরো-টুকরো অংশগুলোর সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল তাই সেগুলো তার কাছে অর্থবহও মনে হচ্ছিল। তার চোখে কিউয়ের প্রতি প্রচুর জিজ্ঞাসা ছিল, সে তার অতীত স্মৃতি পুরোপুরি ফিরে পেতে চাইছিল।
কিউ মাথা নাড়ল, “আমি একমাত্র যে তোমার সঙ্গে ফিরে আসিনি। সেই জন্য, আমিই একমাত্র সেই ব্যক্তি যার স্মৃতিতে কী কী ঘটেছিল তার পুরোটা ধরা রয়েছে। তয়ার এমনকি এ কথাও মনে নেই যে ও আমার ভাই।”
কিওকো এই কথায় ঢোক গিলল, “ভাই? কী ঘটেছিল যে এই বিষয়গুলো শুধু তোমারই মনে আছে?" ওকে জানতেই হবে।
“আমাদের বিশ্বের অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করতে ও রক্ষকের অন্তর-স্ফটিককে রক্ষা করতে তুমি তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তোমার সব স্মৃতি খরচ করে ফেলেছিলে। আর ঠিক তখনই তুমি ওই স্ফটিকের শপথ নিয়ে সকলের সাথে আবার দেখা হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলে। তুমি তাদের হারাতে কখনোই হারাতে চাওনি। তারপর তুমি চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেছিলে, বাকি সকলেও তাই-ই গেছিল... তোমার শত্রুরাও। তুমি তোমার অজান্তেই তাদের এখানে নিয়ে এসেছো... তোমার সাথে করে।”
এই অবধি বলে সে হতাশাসূচক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “আমি আমার চারিদিকে একটা ইন্দ্রজাল বিস্তার করে রেখেছিলাম যা আমাকে ওই ধরনের ইচ্ছাশক্তি থেকে দূরে রেখেছিল,” স্মৃতির গভীরে হাঁতড়ে এই কথাগুলো বলতে বলতে সে সুদূরে তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল।
“তুমি সবাইকে তোমার সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলে কিন্তু তোমার তার কিছুই মনে নেই। তার সকলেই পুনর্জন্ম পেয়ে এখানে চলে এসেছে, তোমার এখনকার সময়ে, আমাকে একা অতীতে ছেড়ে।” এই কথা বলার সাথে সাথে তার চোখ দুটো কিওকোর চোখে এসে স্থির হয়ে গেল। “আর তাই আমি বেঁচে গেছিলাম এবং তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সময় আসা মাত্রই আমি আমাকে ছেড়ে যাওয়া সবাইকে আবার জড়ো করে নিয়েছি। তুমি এখন সেই স্ফটিককে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছো, আর সেই সব অমঙ্গলকারী শক্তিকেও যারা এর অধিকার চায়...” কিউয়ের গলার স্বর গাঢ় হয়ে গেল, “...অশুভ শক্তি ইতিমধ্যেই তোমার খোঁজ শুরু করে দিয়েছে এবং আমি তাদের তোমার কাছে পৌঁছাতে দেব না।”
কিওকো বুঝতে পারার মতো করে মাথা নাড়ল, “তাহলে, আমার মতো করে যারা যারা এখানে এসেছে তাদের কি আমি বিশ্বাস করতে পারি?” কিউ সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল এবং কিওকো বলে চলল, "তারা কি এসবের কোন কিছু জানে?"
কিউ মাথা নেড়ে না বলল, “তারা তোমার সঙ্গে একটা বন্ধন অনুভব করবে এবং সেটা বাড়তে থাকবে, কিন্তু সেটা ছাড়া ভবিষ্যতে আর কী হতে পারে তা আমি জানি না, আমি শুধু অতীতই জানি। তারা তোমাকে আগের মতোই রক্ষা করবে। তা করার জন্যই তারা জন্মলাভ করেছে... সেটাই তাদের অস্তিত্বের কারণ।”
সে দ্রুত কিওকোর জিজ্ঞাসু চোখের থেকে দূরে দৃষ্টি নিয়ে গেল এটা জেনে যে, তার কথার সত্যতা তার সঙ্গেও রয়েছে। “আমাদের হাতে এখনও কিছু সময় আছে, কিন্তু এখনকার মতো আমি চাইব তুমি তোমার ঋত্বিকা-শক্তি লুকিয়ে রাখো, এবং তোমার চারপাশ সম্পর্কে সচেতন থাকো। আমি তোমার উপর নজর রাখব, এবং আমি তয়াকেও বলে রেখেছি তোমার উপর খুব কাছ থেকে নজর রেখে চলতে।”
কিওকো তাকে খুব নিবিড় দৃষ্টিতে দেখল, তার সম্বন্ধে কিছু মনে পড়ে কিনা সেই চেষ্টায়। তার মনে হচ্ছিল সে তাকে খুব ভালভাবে চেনে, জানে। কিউয়ের চোখে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে কৌতুহলী মেয়ের মতো ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, "আমরা কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলাম?"
প্রশ্ন শুনে কিউ কিছুটা শক্ত হয়ে তার থেকে দূরে সরে যাবার আগে তার চারিপাশ থেকে যেন স্নেহের পরশ মাখা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। সে পিছনে হেলাম দিয়ে বসল, দরজার দিকে বড়-বড় চোখে তাকাল এবং তারপর দ্রুত চোখ ফিরিয়ে আনল কিওকোর উপর। “আমি তোমাকে যা যা বললাম সেগুলো তুমি ওদের বলো না কারণ ওরা নিজেরাই আস্তে-আস্তে সেসব মনে করতে পারবে।”
ঠিক তখনই দরজায় একটা সজোরে শব্দ হওয়াতে কিওকো এক ঝটকায় দূরে সরে গেল, এবং কোন অনুমতি ছাড়াই দরজাটা খুলে গেল।
তয়া মেয়েটির নিরাপত্তার ব্যাপারে চিন্তিত ছিল এবং সে ভিতরে এসে দেখতে চাইল কী ঘটছে, যদি কিছু না-ও ঘটে তাহলেও কিউয়ের গুরু-গম্ভীর স্বভাব থেকেও অন্তত কিওকোকে বাঁচাতে। ঘরে ঢুকেই ওর দৃষ্টি কিওকোর উপর স্থির হয়ে গেল।
“যাক, দেখে ভাল লাগছে ও এখনও কথা বলে চলেছে,” তার চোখ দুটো রূপালী রংয়ের দ্যুতি ঠিকরে পড়ছিল এই অনুভূতি থেকে যে, কিছু একটা গণ্ডগোল রয়েছে। “আপনার যদি কিওকোর সাথে কথা বলা হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে সুকি বাইরে ওর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে।” তয়া তার সোনালি চোখের দ্যুতি কিউয়ের উপর নিক্ষেপ করল এটা না জেনেই যে, কিউয়ের চারিপাশে একটা রূপালী আলোর বলয় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল।
কিউ তয়ার দিকে তার স্বভাবসিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল, এবং নিঃশব্দে মাথা নেড়ে ওদের যেতে বলল।
কিওকো তয়ার দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকাল, কারণ এখন তার মধ্যেকার নতুন চেতনা তাকে বলছিল তয়া তার ব্যাপারে চিন্তিত ছিল, যদিও সে তার আচরণে তা বুঝতে না দিলেও।
'তোমার জন্য সে তার জীবনও দিয়ে দিত।' কিউয়ের কথাগুলো ওর মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
কিউ তয়ার সাথে কিওকোকে সহজ হয়ে যেতে দেখছিল, এবং দূরত্ব রেখে হলেও তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার আঁচ পেয়ে সে একটু চোখ পাকাল। তার এই ধরনের অনুভূতির ব্যাপারে সে ওয়াকিবহাল ছিল, এবং রূপালী চোখের রক্ষকের উপর তার চোখ দুটো কেন্দ্রিভূত হয়ে গেল। কিওকো কি সবসময়েই তার ভাইয়ের সঙ্গে এমনই একটা বন্ধন রেখে চলবে যা সে অন্য কারো সাথেই রাখে না?
কিওকো উঠে দাঁড়াল, কিউয়ের উদ্দেশ্যে একটা অন্তরঙ্গ হাসি হেসে তাকে বিদায় জানাল যেটা তয়ার চোখে পড়ল না, তারপর তয়ার দিকে ঘুরে তার স্বভাবসিদ্ধ মিষ্টি হাসি নিয়ে তয়ার দিকে এগিয়ে গেল। “চলো, সুকিকে আর অপেক্ষা করিয়ে রাখা ঠিক হবে না।” এই বলে সে তয়ার পাশ দিয়ে হেঁটে দরজার বাইরে চলে গেল, আর তয়া তার এই উষ্ণ আচরণে স্থির হয়ে সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এক এমন অনুভূতি যা সে কিওকোর মিষ্টি হাসির মধ্যে দিয়ে পেয়েছিল।
সে নিজের মাথা ঝাঁকিয়ে কিওকোর থেকে আসা সেই উষ্ণতাকে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করল এবং তারপর কিউয়ের দিকে কটমট করে তাকাল এবং দেখল সে তখনও ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। “কী হল?” তয়া কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল এটা জেনেও যে সে তার কোন উত্তর পাবে না। সে আর বেশি জল ঘোলা করতে চাইল না এবং দরজাটাকে দড়াম করে বন্ধ করে দিয়ে বাইরে চলে গেল এবং দ্রুত পায়ে হেঁটে কিওকোর পাশে এসে উপস্থিত হল।
তয়া পিছন থেকে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাওয়া কিওকোকে দেখছিল। সে নিশ্চয়ই কিউয়ের থেকে যত দ্রুত সম্ভব দূরে চলে যেতে চাইছিল। তয়া নিজের মধ্যেই মুচকি হাসল, তাকে ধরার জন্য দ্রুত পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল, নিজেকে রক্ষকের ভূমিকায় বিবেচনা করে। তার ভাবনা কিছুটা গভীর হল এই ভেবে যে, কিওকো কি আদৌ জানে তয়া আসলে কে। এ ব্যাপারে তার সন্দেহ ছিল, না হলে সে তার দিকে তাকিয়ে ওভাবে হাসত না।
সিঁড়ির একেবারে উপরে কিওকো বুঝতে পারছিল তয়া তাকে ধরে ফেলেছে কারণ সে তার পিছনে তয়ার উপস্থিতি অনুভব করতে পারছিল। হ্যাঁ, কিওকো তার শক্তিশালী উপস্থিতি বেশ বুঝতে পারছিল, কিন্তু সেই অনুভূতি কিছু হলেও কিউয়ের থেকে আলাদাই ছিল। সে এক মুহূর্তের জন্য তার দু’চোখ বন্ধ করে নিল। এই ভাবে চোখ বন্ধ করে সে তার দেহসৌরভ নিতে চেষ্টা করল তা সে যতই খারাপ ব্যবহার তার সঙ্গে করে থাকুক না কেন, কিন্তু তার দেহসৌরভ তাকে উষ্ণতা দিচ্ছিল এবং সে... আরও অনেক কিছুর মধ্যে... খুবই সুরক্ষিত বোধ করছিল।
সে বুঝতে পারছিল তয়ার বয়স কিউয়ের থেকে কম হওয়ার কথা, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার মধ্যে যে নিহিত শক্তি ছিল তা সে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিল। এমন এক শক্তি যা, যদি তাকে ধরা যায়, তয়াকে এক নিমেষে তার দাদাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে... যদিও তাদের দু’জনের মধ্যে কেউ সে ব্যাপারে সতেচন কিনা তা নিয়ে তার সন্দেহ হচ্ছিল। কিওকো তার এই ধরনের চেতনার ব্যবহার খুব উপভোগ করছিল, বিশেষকরে যখন সে আবার তা নিজের মধ্যে ফিরে পেয়েছিল।
"তাহলে…" সে তয়ার দিকে ফিরল, "…সুকি আর শিনবে কই?"
তয়া তার চোখ ছোট করে ওর দিকে তাকাল কারণ তার মিথ্যে ধরা পড়ে গেছিল। সুকি আর শিনবে কোথায় সে কীভাবে জানবে? সে তো শুধু কিওকোকে কিউয়ের থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার জন্যই ঘরের মধ্যে গেছিল।
“আমি জানি না,” সে অলস কণ্ঠে ভেঙ্গে-ভেঙ্গে কথাগুলো বলল।
কিওকো ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল, “কিন্তু তুমি তো বলেছিলে...”
তয়া তাকে কথা শেষ করতে দিল না। “তোমাকে বাঁচানো জন্য তোমার আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ,” কিওকোর দিকে ঝুঁকে পড়ে তাকে কিছুটা ভয় পাইয়ে দেবার মতো ভঙ্গিতে সে তাকে বলল।
"আমাকে কীসের থেকে বাঁচানোর কথা বলছো?” তার এই উত্তর সে পছন্দ করেনি এটা বুঝিয়ে দিয়ে কিওকো গজগজ করে তার মুখের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করল। এমন এক বিরক্তমাখা বিস্ময় যার প্রত্যাশা সে হয়ত করছিল।
“কিউয়ের থেকে,” তয়া হাতের মুখো পাকিয়ে কিওকোর কথার পিঠেই গজগজ করে কথাগুলো বলল। কিওকো তার মিষ্টি মুখটা বেঁকিয়ে তার কথায় নিজের অসম্মতি জানাল। ‘মিষ্টি মুখ?’ কোথা থেকে যে এল সেটা? তয়া কিছুটা বিভ্রান্তের মতো কিওকোর দিকে তাকিয়ে তার থেকে এক পা পিছিয়ে গেল।
তারপর অবাক হল এটা দেখে যে, কিওকো প্রায় এক মিনিট ধরে ফ্যাল-ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর হঠাৎই সে প্রথমে আস্তে-আস্তে, আর তারপর উচ্চস্বরে হো-হো করে হেসে উঠল। "তুমি বাঁচিয়েছো?” হাসতে-হাসতেই সে কিছুটা দম নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করল। “তুমি বাঁচাতে যাবে কেন...” সে তারা হাসির গতি থামিয়ে আস্তে-আস্তে জিজ্ঞাসা করল, এবং সবশেষে তার হাসিতে একটু দুষ্টুমির ভাব নিয়ে এসে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
“ব্যাপারটা খুবই আনন্দের। আমি জানতাম না তুমি এতটা খেয়াল রাখতে পার,” সে তার দিকে তাকিয়ে মুখ একেবারে সোজা রাখার চেষ্টা করে নিজের নাক কুঁচকালো।
তয়াও তার প্রত্যুত্তরে গোল-গোল চোখ করে কিওকোর দিকে তাকাল। "তাহলে এত কিছুর পরও কি তুমি এখানে থেকে যেতে চাইবে, ‘ঋত্বিকা’?” শেষ শব্দটা সে এমনভাবে উচ্চারণ করল যেন শব্দটা তার মুখে একটা বিস্বাদ ভরে দিয়েছিল।
কিওকোর হাসি মিলিয়ে গেল এবং সে তার মাথাটা উপরের দিকে তুলে কটকট করে তয়ার সোনালি চোখের উপর নিক্ষেপ করল। "হ্যাঁ, আমি চাইব, ‘রক্ষক’," এক দিকের চোখের ভ্রু নাচিয়ে সে কথাগুলো বলল, আর তারপর পিছন ঘুরে হাসতে-হাসতে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।
‘হ্যাঁ!’ কিওকো নিজের মনে বলল এবং তার দিকের বোর্ডের উপর মনে-মনেই একটা টিক চিহ্ন বসিয়ে দিল। ‘কিওকো এক… তয়া শূন্য।’
দুষ্টু-মিষ্টি মেয়েটা যে তার মনে প্রবেশ করে গেছে সেটা বোঝার আগেই তার চোখ দুটো প্রসারিত আনন্দে প্রসারিত হল। “ধুৎ!” বলে সেও তার পিছনে-পিছনে ছুটতে লাগল।
কিওকো প্রায় সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে খেয়াল করল তার ঋত্ত্বিক চেতনা যেন কোন কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। তয়ার পাশে আরও এক রক্ষকের উপস্থিতি অনুভব করে কিওকো চারিপাশটা দেখার জন্য তাকাল। এই ধরনের অনুভূতি তৈরি করতে পারে এমন সবচেয়ে কাছে থাকা যাকে সে দেখল সে একজন ছাত্র যে সিঁড়ির ঠিক নিচেই দাঁড়িয়েছিল, আর কিওকোকে উৎসাহ ভরা চোখে দেখছিল।
কাছ থেকে তাকে দেখে কিওকো তার অবিন্যস্ত চুলের হালকা বেগুনি হাইলাইট এবং তার অত্যন্ত সুন্দর দুটো চোখ দেখতে পেল। চোখ দুটোর দিকে ভাল করে তাকিয়ে কিওকো হলফ করে বলতে পারত... সে তার দুই চোখের তারায় বর্ণালীর সবকটা রংয়ের ঝলকানি দেখতে পেয়েছিল।
এই সময় তয়া কিওকোর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। ওকে হঠাৎ করে থেমে যেতে দেখে তয়া লক্ষ্য করল সে আসলে কামুইকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ‘বেশ, ও তাহলে এখন চিরঞ্জীবীদের শনাক্ত করতে পারছে,’ তয়া মনে-মনে ভাবল। তয়া একটু নিচে ঝুঁকে কিওকোর হাতটা ধরে নিল, “চলো আমি ওর সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিই।”
কামুইয়ের সাথে প্রথমবার দেখা হওয়ার সাথে-সাথেই তয়ার ওর জন্য একটা আলাদা স্নেহ তৈরি হয়েছিল। কামুই সম্পর্কে তয়া যতটুকু জানত তা হল, ওর বাবা-মা নেই এবং সে কোন শিশু পালক সংস্থার তত্ত্বাবধানে বড় হচ্ছিল যতদিন না কিউ তাকে এখানে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছিল।
কিওকো নিজেকে তয়ার হাতে ছেড়ে দিয়েছিল যাতে তয়া তাকে টেনে আগন্তুকের কাছে নিয়ে যেতে পারে। সে যে একজন চিরঞ্জীবী তা কিওকো বুঝতে পারছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার মধ্যে এক অস্বাভাবিক উদারতা সে লক্ষ্য করতে পারছিল। সে তার উপস্থিতিকে নিবিড়ভাবে নিরীক্ষণ করছিল এবং তার মধ্যে একটা উষ্ণতা অনুভব করতে পারছিল... এমন এক নিহিত অপাপবিদ্ধতা যা শুধু একটি শিশুর মধ্যেই থাকে।
"আরে তয়া, তুমি কাকে এখানে নিয়ে এসেছো?" কামুইয়ের চকচকে চোখ দুটো অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে কিওকোকে দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল সে যেন বহু কাল কিওকোর অপেক্ষাতেই ছিল... এমন কি কিওকো আসলে কে সে ব্যাপারে তার কোন ধারণা না থাকা সত্ত্বেও। ভাবটা কিছুটা এমন যে সে ভীষণভাবে ওর অভাব বোধ করছিল। মনে হচ্ছিল সে যেন নতুন করে নিঃশ্বাস নিতে পারছিল এবং সে সেই মুহূর্তে একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে তা প্রমাণের চেষ্টা করল, কিন্তু নিঃশ্বাস নেওয়া বায়ু তার শ্বাসনালী দিয়ে যাবার সময় সে যেন তাতে কিওকোর গন্ধ পেল যার সঙ্গে সে খুবই পরিচিত ছিল।
তয়ার দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কী করলে... যাও নিজের জন্য একটা গার্লফ্রেন্ড খুঁজে নাও গে?” মুচকি হেসে কথাগুলো বলার সময় কামুইয়ের চোখ দুটোতে অন্যরকম চমক ছিল।
“যাচ্ছেতাই,” তয়া বলে উঠল। “ও একেবারেই আমার পছন্দ মতো নয়।”
“তুমি সেটা বুঝবে কীভাবে? তোমার তো কোনদিন কোন গার্লফ্রেন্ডই ছিল না।” নিজের বলা কথা শেষ করে কামুই নিজেই হো-হো করে হেসে উঠল।
কিওকো না হাসার অনেক চেষ্টা করল কিন্তু কামুইয়ের হাসি আর ওর চোখের ভঙ্গির সাথে তয়ার মুখের ভাব দেখে সে আর তার হাসি চেপে রাখতে পারল না।
“ও কিওকো,” তয়া কিওকোর দিকে হাত প্রসারিত করে তাকে দেখালো যেন সেটা কিওকোকে স্পর্শ করার কথা মনে করতে পারছিল। “কিওকো, ওর নাম কামুই। কামুইও এখানে তোমার মতোই স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে এসেছে, আর তোমরা দু’জনে একই ক্লাসে পড়বে।”
“হ্যাঁ, আমি এখানে মুফতে খাওয়াদের মধ্যে একজন, ” মুখ উঁচু করে এমন ভঙ্গিতে কামুই কথাগুলো বলল যে কিওকো হাসি চেপে রাখতে পারলা কারণ সে সেই দলে সে-ও যে পড়ছিল।
সে কামুইয়ের দিকে ঘুরল এবং নিজের হাত বাড়িয়ে দিল। তার মুখে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি ছিল আর নিজের ভিতরে সেই তথ্যটা চাপা দেওয়ার প্রয়াস যে, কামুই যদি এখানে স্কলারশিপ পেয়ে এসে থাকে, তাহলে সে-ও এমন কেউ যাকে কিওকো অতীতে চিনত, “হাই কামুই, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লাগল। অ্যাকাডেমিতে তুমি কতদিন ধরে রয়েছো?"
কামুইয়ের ইতিমধ্যেই এই মিশুকে মেয়েটাকে পছন্দ হয়ে গেছিল। “বছর দুয়েক মতো। রগচটা ছেলেটা তোমার সঙ্গে কী করছে? তোমাকে সব ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে বুঝি?" এই বলে সে তয়ার দিকে তাকাল, তারপর আবার কিওকোর দিকে, এবং হাসি মৃদু করে আনল। কামুই এইবার কিওকোর একটা হাত তার হাতের মধ্যে নিল। শরীরটা কিছুটা ঝুঁকিয়ে হাতটাকে নিজের ঠোঁটের কাছে টেনে এনে তালুর উল্টো দিকে একটা চুম্বন করল।
এই দেখে তয়া যেভাবে কটমট করে তার দিকে তাকাচ্ছিল তাতে কামুই হো-হো করে হেসে উঠল। কিওকোর প্রতি তয়ার আকর্ষণ এতটাই স্পষ্ট ছিল যা শুধু একজন নির্বোধেরই চোখ এড়াতে পারত।
কিওকো একটু লজ্জা পেল এবং ‘রগচটা’ শব্দটা মনে করে মুখ চেপে হাসল। তয়া যেভাবে কামুইয়ের দিকে কটমট তাকাচ্ছিল তা দেখে কিওকো বেশ মজা পাচ্ছিল। “আমরা আসলে শিনবে আর সুকির খোঁজ করছিলাম। তুমি কি ওদের দেখেছো কোথায়...”
কিওকো তার কথা শেষ করার আগেই কেউ তার হাতটা ধরে তাকে এক টানে কামুই আর তয়ার মাঝখান থেকে সরিয়ে নিল। কিওকো হতচকিত হয়ে তার দিকে তাকাতেই তার চোখ দুটো সুকির চিন্তিত চোখের উপর গিয়ে পড়ল।
"সব ঠিক আছে তো কিওকো? তুমি শেষ অবধি থাকছো তো তাহলে?" সুকির জিজ্ঞাসায় যেন অনুনয়ের ছাপ ছিল।
সুকির কথা শুনে কিওকোর কিউয়ের মৃদু গলায় তাকে থেকে যাবার অনুরোধের কথা মনে পড়ে গেল এবং সে সুকির উদ্দেশ্যে সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল। “আমি যাচ্ছি না।” এই কথা বলতে-বলতে সে সুকির কাঁধের পিছন দিয়ে শিনবেকেও দেখতে পেল এবং তার এই উত্তরে শিনবের চোখেও একইরকম সন্তুষ্টির ছাপ লক্ষ্য করল।
কিওকোর কথায় তয়া তার একটা ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকাল। সে বুঝতে চেষ্টা করছিল কিউ তাকে ঠিক কী বলেছে যার জন্য কিওকো এখানে থাকার ব্যাপারে এতটা দৃঢ়তার সঙ্গে মাথা নাড়ল। এখন কিওকোকে আগের থেকে অনেকটাই আলাদা লাগছিল, তাকে বেশ আনন্দিত দেখাচ্ছিল। কিউ সাধারণত যখনই কারো সাথে একান্তে কথা বলে... তাদেরকে পরের কয়েক ঘণ্টা বেশি অপ্রস্তুত অবস্থায় চলাফেরা করতে দেখা যায়। লোকটার মধ্যে তাকেও থতমত খাইয়ে দেবার ক্ষমতা রয়েছে।
কিওকো সুকির হাতটা ধরল এবং সিঁড়ির দিকে হেঁটে যেতে শুরু করল, “আমরা যদি আজ রাতে ডান্স করতে যাই, তাহলে আমি যাতে ঠিকঠাক পোশাক পরে যেতে পারি তার জন্য তোমায় আমাকে সাহায্য করতে হবে।” মেয়ে দুটি নিজেদের মধ্যে কথা বলতে-বলতে হেঁটে বেরিয়ে গেল। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন একে-অপরের চিরকালের চেনা।
শিনবে, কামুই আর তয়া পিছনে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল। শিনবে একটু চিন্তিত স্বরে তয়াকে জিজ্ঞাসা করল, "এখানে আসলে কী চলছে তা কি ও সত্যিই জানে?"
তয়া কিওকোর মিলিয়ে যাওয়া শরীরটার দিকে দেখতে-দেখতে বলল, “হ্যাঁ, আমার তো তাই মনে হয়।” তারপর সে ওদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বিষয় পরিবর্তন করে বলল, "কামুই, আজ রাতে কি তুমি আমার সাথে যাবে?"
শিনবে একটু উসখুস করল। "তয়া? তুমি কি সত্যিই ডান্সে যাবে?" সে যেন কিছুটা হতচিকত হয়েছিল। সে মনে মনে ভাবল, 'ওকে তো তয়ার মতো লাগছে না।'
"দেখো, আমাকে বলা হয়েছে ওর উপর শকুনের দৃষ্টিতে নজর রাখতে, তাই আমার তো কোন উপয়াই নেই, তাই না?" তয়া কিছুটা বিরক্তির সুরে কথাগুলো এমনভাবে বলল যেন সে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ডান্সে যাবে। কিন্তু আসলে সে কিওকোকে তার চোখের আড়াল করতে চাইছিল না।
তার নাড়ির স্পন্দন দপদপ করে যেন তাকে বলছিল যে কোন মূল্যেই ওকে রক্ষা করতে হবে, কেউ তাকে তা বলল কি না বলল তাতে কিছু এসে যায় না। আর এই মুহূর্তে সে তার মনঃশ্চক্ষে একটা ডান্সিং ফ্লোরে কিওকোকে তার নাড়ির স্পন্দনের তালে-তালে তার চারিপাশে নৃত্যরত অবস্থায় দেখতে পাচ্ছিল। তার রক্ষকের প্রবৃত্তি হঠাৎ করেই তীব্র আকার ধারণ করেছিল।
তয়া গলা দিয়ে এক মুহূর্তের জন্য একটা হালকা গর্জন বেরিয়ে এসেছিল এবং সে তার দিকে তাকিয়ে থাকা একাধিক চোখের যে ছবি তার মনের মধ্যে ফুটে উঠছিল সেগুলোকে দূর করার জন্য তার মাথা ঝাঁকাল... যে চোখগুলো শুভ নয়।
“হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগছে। কিন্তু আমিও যাচ্ছি,” কামুই একটু চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল। “সপ্তাহের শেষের দিনগুলোতে অনন্ত আমাদের অন্যরকম কিছু করা দরকার যাতে এখানের একঘেয়ে রুটিনের থেকে আমরা একটু বাইরে বেরোতে পারি।” কিওকো যে এবার থেকে তাদের আশে-পাশে থাকতে চলেছে তা জানতে পারায় তার চোখে-মুখে একটা স্বস্তির ছাপ দেখা যাচ্ছিল। “সেই সঙ্গে তয়ার জন্য আমাদের একটা গার্লফ্রেন্ড খুঁজতেও তো হবে,” এটাও সে কিছুটা চিবিয়ে-চিবিয়েই বলল।
“আমার গার্লফ্রেন্ড চাই তোমায় কে বলল গবেট,” কামুইয়ের দিকে কটমট তাকিয়ে তয়া কথাগুলো বলল। “গার্লফ্রেন্ড ল্যাং মারলে তখন বুঝতে পারবে গার্লফ্রেন্ড কাকে বলে।”
শিনবে মুচকি হেসে বলল, “আমার মনে হয় এখানে একমাত্র আমিই সেই ব্যক্তি যে জানে গার্লফ্রেন্ড কাকে বলে, আর তোমরা দুই গার্লফ্রেন্ড-হীন যদি তা জানতে চাও আমি তোমাদের তা দেখাতেও পারি।” এই কথা শুনে দু’জনেই যখন ওর দিকে ফিরল এবং খুনীর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল ও তখন দু’পা পিছিয়ে গেল।
শিনবে দ্রুত বিষয়টা বদলে অন্য কিছু বলবার জন্য তয়ার দিকে এগিয়ে গেল। "কিউ তোমাকে কিওকোর উপর নজর রেখে চলতে বলেছে,?" এই বলে সে কিওকোর চলে যাওয়া পথটার দিকে চোখের ইশারা করল। “বুঝলে... সম্প্রতি আমি এই জায়গাটায় কিছুটা ভারসাম্য বদলের অনুভূতি পেয়েছি, যেন কোন কিছু ঘটার প্রস্তুতি চলছে। অশুভ শক্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। এর সঙ্গে কিওকোর কোন যোগ আছে কিনা তা জানার ইচ্ছা রয়েছে।” শিনবের কিছু কিছু প্রবৃত্তি সবসময়েই ঠিকঠাক কাজ করে আর সেই জন্যই সে চিন্তিত ছিল।
তয়ারও সেরকমই কিছু মনে হচ্ছিল, আর তাই সে-ও এর উত্তর চাইছিল। “দেখো, এর থেকে ভাল সময় আর পাওয়া যাবে না। আমি কি উপরে গিয়ে ওকে সরাসরি ওর থেকে সত্যিটা জানতে চাইব?" ওর মনে হচ্ছিল কিওকো কিছু একটা লুকোচ্ছে, আর তয়া চাইছিল সেটা উদঘাটন করতে।
শিনবে তাকে আটকাবার আগেই তয়া দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। শিনবে একটু আশংকিত হয়ে বলল, “ওরা দু’জন মুখোমুখি হওয়াটা বেশ ঝামেলার। আমি আগেও দেখেছি, তখনও ভাল অশান্তি হয়েছে। ওরা দুই ভাইয়ের মতো বা ওইরকম একটা আচরণ করে।” শিনবের নীলার মতো চোখ দুটো সিঁড়ির দিকেই তাকিয়েছিল, আর তয়াকে দুটো করে সিঁড়ি চড়তে-চড়তে উপরে উঠে যেতে দেখছিল।
একমাত্র কিউই যে তাকে মাঝে-মাঝে ঠাণ্ডা করতে পারে এই কথা ভেবে কামুই মাথা নাড়ল। “ও না গেলে আমি আছি। আজ রাতে তোমার সাথে দেখা হবে,” এই বলে সে সেখান থেকে চলে গেল, আর শিনবে সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সিঁড়িটার দিকেই তাকিয়ে রইল।
শিনবের মনে গভীরে, যেখানে তার রক্ষকের শক্তির প্রতিফলন তারই হৃদয়ের মধ্যে ঘটছিল, নতুন এই ঋত্বিকা সম্পর্কে তার খুবই পরিচিত কিছু অনুভূতি আসা-যাওয়া করছিল। সে তার চোখ দুটো বন্ধ করে নিজের মনের গভীর হাঁতড়ে সত্যের সন্ধান চালাচ্ছিল।
তার নীলার মতো চোখ দুটো আবার সে যখন মেলল, তখন সে দুটো চকচক করে উঠল সেই রহস্য উদ্ঘাটন করতে পেরে যা শুধু তারই জানার কথা।
*****
কিউ কিওকোকে কীভাবে সামলাবে সেই চিন্তায় মগ্ন ছিল, কারণ সে শেষ অবধি কিওকোকে যেখানে আনতে চেয়েছিল সেখানে নিয়ে আসতে সফল হয়েছিল। সহসা দরজায় জোরে-জোরে আঘাতের শব্দ তার সেই চিন্তা মগ্নতায় ছেদ ঘটাল। সে বার কয়েক তার চোখ পিটপিট করেই তার সোনালী চোখ দুটো স্থির করে দিল এটা বুঝতে পেরে যে দরজার বাইরে যে রয়েছে সে তয়া। কিউ সোজা দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল এবং তখনই দরজাটা কোন আমন্ত্রণ ছাড়াই তার সামনে খুলে গেল।
তয়া সোজা ভিতরে চলে এসে দেখল সে যার উদ্দেশ্যে এসেছে সে ভিতরেই রয়েছে এবং একটা সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। "কিওকোর ব্যাপার-স্যাপারটা কী বলো দেখি?" সে সরাসরি কাজের কথায় চলে এল।
কিউয়ের চোখ দুটো তয়ার উপর যেন বাণের মতো বিদ্ধ হল, কিন্তু তার মুখে তয়ার প্রশ্নের প্রতি কোন আগ্রহের ছাপ তৈরি হল না।
কিউয়ের মেজাজ তয়ার থেকে ভাল আর কেউ জানত না, এবং সে জানত যে কোন বিষয় যদি তার মনকে ধাক্কা না দেয় তাহলে সে তার দিকে তাকাবেও না। কিউয়ের মন পড়া তার কাছে একাট বিজ্ঞানের মতো। কিউ যদি একবার চোখের পলকও ফেলে তাহলেও তাতে কিছু না কিছু নিহিত থাকে। তয়া কিউয়ের উল্টোদিকে একটা গদিমোড়া চেয়ারে গিয়ে বসল।
“শোন, আমি কিন্তু নির্বোধ নই। তুমি যদি চাও আমি ওকে রক্ষা করি, তাহলে আমি কেন তা করব তা কিন্তু আমাকে বলতে হবে। হাজার হোক, এখানে বাকি সবাই নিজের-নিজের মতো থাকব, তাহলে ও-ই বা আলাদা কিছু হবে কেন?" সে তারা হাত ঝটকালো এটা বোঝানোর জন্য যে ব্যাপারটা তার কাছে বেশ বিরক্তিকর। “ও তো একটা দুর্বল মানব কন্যা মাত্র।”
তয়া কিউয়ের নখর হাতটা চেপে ধরল এবং হঠাৎ করেই দেখল সেটা তার গলায় উঠে এসেছে, এবং সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ দুটো কিউয়ের ক্রুদ্ধ চোখের উপর পড়ল।
“আমি যা বলব তোমাকে তা-ই করতে হবে,” কিউয়ের গলা রাগে কাঁপছিল।
তয়ার চোখ ছোট হয়ে এল। সে জানত কিছু একটা হয়েছে। “বেশ।” সে কর্কশ কণ্ঠে বলল, এবং তার পুরস্কারস্বরূপ কিউয়ের হাত তার গলা থেকে নেমে গেল। সে দেখল মুহূর্তের মধ্যে কিউয়ের ক্ষিপ্ততা যেন জল হয়ে গেল এবং সে তার আগের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল, তার মুখের উপর শান্ত স্বভাবের মুখোশটা নেমে এলো যেন। তয়া মাথা নাড়ল। "ও কেন ‘তোমার’ কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ তা তোমাকে বলতেই হবে।" তোমার শব্দটায় তয়া বেশ জোর দিল।
কিউ তাতে কিছুটা একমত হল বলে মনে হল। সে তয়াকে তার জন্মের সময় থেকেই মানুষ করে এসেছে। সে জানত তার ভাই তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার মুহূর্তেই তার খুব কাছেই ছিল এবং সে তাকে সেই বাবা-মার থেকে চুরি করে নিয়ে চলে গেছিল যারা হয়ত তয়াকে ঠিকঠাক মতো মানুষ করতে পারত না। তার অন্যান্য ভাইবোনেদের ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটেছিল, যদিও কিছু সময়ের পর থেকে কিউ দূর থেকেই তাদের দেখাশোনা করত।
কিউয়ের আশা ছিল সে তয়ার ব্যক্তিত্বকে কিছুটা অন্যরকমভাবে গড়ে দিতে পারবে, কিন্তু মনে হচ্ছিল যেন তা আর সম্ভব নয়, বাকি জীবনটা সে হয়ত একইভাবে থেকে যাবে কিউ যতই চেষ্টা করুক না কেন তাকে বদলাবার। মোদ্দা কথা হল তয়া আসলে তয়াই হয়ে থেকে গেছে, জীবন যে দিকেই যাক না কেন। এটা হতেও পারে যে কিউকোর সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে অতীতের চিন্তা তাকে কিছুটা প্ররোচিত করছে, কিন্তু তার ভাইয়ের মধ্যে সে তেমন কিছুই এখনও দেখতে পাচ্ছে না। এই কথাটাই কিউয়ের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ ফেলল।
"তোমার মধ্যে কি ওর জন্য কোন অনুভূতিই নেই?” কথাটা কিউ এমন একটা ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল যা তয়াকে কিছুটা সঙ্কুচিত করল।
"আমার সেরকম কিছু থাকার কথা কি?" তয়া প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, এটা জেনেই যে, কিওকোর জন্য তার মনে কিছু তো রয়েইছে, কিন্তু তার স্বীকারোক্তি প্রকাশ না করেই। কিউয়ের দিকে তার হাত দুটো জড়ো করে সে তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে রইল, কিউয়ের সোনালি চোখের চাউনির ওপার থেকে কী উত্তর আসতে পারে তা না বুঝেই।
“হ্যাঁ,” শান্ত কণ্ঠে উত্তর এল।
“ধুত্তোর! ও আমাদের কাছে এতটা গুরুত্ব পাচ্ছে কেন?" হাত দুটোকে উপরে ছুঁড়ে দিয়ে তয়া তার বিরক্তি প্রকাশ করল।
কিউয়ের চোখের চাউনি তার বিরক্তিকে চ্যালেঞ্জ করল, “ও সে যার জন্য আমরা অপেক্ষা করে বসেছিলাম।”
তয়ার চোখ প্রসারিত হল। যতদূর অতীত সে মনে করতে পারে মনে করে দেখল, কিউ তাকে বলেছিল তাদেরকে সেই মানুষটার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকতে হবে যে রক্ষকের অন্তর-স্ফটিক তার অন্তরের মধ্যে নিয়ে চলে গেছে। সে নিঃসন্দেহে কিওকোকে বোঝাতে চায়নি... এত শক্তিশালী একটা স্ফটিক কীভাবে এতটা হীনবল একটা মেয়ের অন্তরে থাকতে পারে? আর সেই জন্যই তো সে কোন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জাতীয় কারো অপেক্ষায় বসেছিল... কোন সাদা-মাটা মেয়ের অপেক্ষায় নয়।
“তুমি কি ওই মেয়েটার জন্য এত লোকজন জড়ো করেছো?” চোখের ভ্রু তুলে সে কিউয়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল।
কিউ বরাবর তার অতীত সম্পর্কে তয়াকে বলা থেকে বিরত থাকতে চেয়েছে, কিন্তু সে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাকে সবসময়েই সতর্ক করে এসেছে। “তোমাকে যে কোন অবস্থায় ওকে রক্ষা করতেই হবে।”
তয়ার মনে চিন্তার ঘুর্ণবাত শুরু হয়ে গেল এবং গোটা ঘরটায় একটা নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল। সম্প্রতি সে এই গোটা অঞ্চলটাতেই কিছু দানবীয় স্পন্দন অনুভব করছে, যেন নতুন নতুন দানবের জন্ম হচ্ছে এখানে, এবং অশুভ শক্তির প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
“বেশ, তাহলে ও-ই সেই। আমার আর কী কী জানা দরকার?" এতক্ষণে তাকে কিছুটা স্বস্তি পেতে দেখা গেল এটা জেনে যে কেন তার ভাই কিওকোর ব্যাপারে এতটা আগ্রহ দেখাচ্ছে, কিন্তু এই মুহূর্তে সে সেই সব অনুভূতিগুলোর গভীরে যেতে চাইল না যেগুলো ঈর্ষার ইঙ্গিতবহ।
কিউ এতকাল ধরে সত্যিটা লুকিয়ে রেখে আসছিল, সে যে সত্যিটা তাকে জানাবে সে ব্যাপারে তয়া নিশ্চিত ছিল না। অতীতে কিওকো যে তয়ার খুব কাছাকাছি ছিল তাতে তেমন কোন সুবিধা হয়নি। কিছু জিনিস বোধহয় ভুলে যাওয়াই ভাল। এরা দু’জনে সময় থেকে অবিচ্ছিন্ন। “ওকে রক্ষা করার জন্যই তোমার পুনর্জন্ম হয়েছে, আর আমি ওর অপেক্ষায় এক হাজার বছর থেকে বেঁচে আছি। এখনকার মতো... তোমার এটুকু জানলেই চলবে।"
তয়া শ্বাস টেনে একটা হিস করে শব্দ করে তারপর দুষ্টুমিমাখা হাসি হাসল। “আমার ব্যস এটুকুই জানা দরকার, তাই না?” সে তার তীব্র রাগ প্রকাশ করে নিজের লম্বা-লম্বা চুলে হাত চালিয়ে দিল, হয়ত মাথাটা একটু ঠাণ্ডা করতে চাইল। “সেই জন্যই কি ওর দিকে দেখার সময় তোমার চোখে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি থাকে? তুমি বলেছো আমরা ঘনিষ্ঠ ছিলাম... তুমি কি আসলে সেই মেয়েটির ব্যাপারে বহুকাল আগে ঘটে যাওয়া এমন কোন কিছু নিয়ে ঈর্ষাণ্বিত যে তোমার দিকে আড়চোখেও তাকাবে না?” তয়ার চোখ জ্বলে উঠল... ওর চোখ দুটো এখন যেন গলিত রূপো।
কিউ তয়ার এই অনুমান শক্তি দেখে ফুঁসছিল। এমন একটা সময় ছিল যখন এই ছেলেটার রহস্যজনক অবধারণ ক্ষমতা ছিল।
“আমার ধৈর্য্যের সীমারেখা লঙ্ঘন করো না তয়া। স্ফটিক ফিরে পাই বা না পাই আমি তোমার অভিযোগ বা পাগলের প্রলাপ কিন্তু সহ্য করে যেতে পারব না, বিশেষ করে যদি তা ঋত্বিকাকে নিয়ে হয়। তোমাকে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে... তুমি তা করতে পছন্দ করছো না করছো না তাতে আমার কিছু এসে যায় না। তোমার বদমেজাজকে কাবু করতে হবে এবং তার সামনে থাকাকালীন তোমাকে তোমাকে কোনরকম অনুমান করা থেকে দূরে থাকতে হবে। বুঝতে পারলে?” এই কথাগুলো বলতে বলতে সে তার ছোট ভাইয়ের দিকে আগুন-ঝরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
কিউয়ের কথায় যেন তুষার-শলাকা তৈরি হয়েছিল, এবং তয়া এখনকার মতো তাদের কথাবার্তা শেষ হয়েছে বলে ধরে নিয়েছিল। তয়া তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল এবং একবারও পিছনে বা অন্য কোন দিকে না দেখে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দাদার কমরা থেকে বেরিয়ে সে একটু থমকে দাঁড়াল, কিওকোর ঘরের দরজার দিকে মুখ করে। সে ঘরটার মধ্যে কিওকোর উপস্থিতি অনুভব করতে পারলছিল।
সে দরজায় টোকা দেবার জন্য তার হাত তুলেছিল তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটানোর জন্য, কিন্তু তা কেন সে চাইছে তার কোন কারণ সেই মুহূর্তে তার জানা ছিল না। সে দ্রুত তার হাতটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিল এবং ঘুরে গিয়ে হলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করে দিল।
ওই হলঘরে যদি আর কেউ থাকত তাহলে সে তয়ার দু’পাশ দিয়ে চকচকে আবছা দুটো রূপালী রংয়ের ডানা দেখতে পেত যা তার হাঁটা শুরু করার সাথে সাথে ধীরে-ধীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকল।
Конец ознакомительного фрагмента.
Текст предоставлен ООО «ЛитРес».
Прочитайте эту книгу целиком, купив полную легальную версию (https://www.litres.ru/pages/biblio_book/?art=65971366) на ЛитРес.
Безопасно оплатить книгу можно банковской картой Visa, MasterCard, Maestro, со счета мобильного телефона, с платежного терминала, в салоне МТС или Связной, через PayPal, WebMoney, Яндекс.Деньги, QIWI Кошелек, бонусными картами или другим удобным Вам способом.